মুক্তিযুদ্ধের নাটক ও চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ

কখনো রহস্যময়, কখনো আবার চিরাচরিত সাধাসিধে বাঙালি। কেউ বলতেন 'মিসির আলী,' কেউবা আবার 'হিমু' কিংবা 'শুভ্র'র সঙ্গেও মেলানোর চেষ্টা করেছেন তাকে। জীবনযাপনে আপাদমস্তক বাঙালির মনের দরজায় টোকা মারা মানুষটিই সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। আধুনিক ও তরুণ পাঠকদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের ৭ম মৃতু্যবার্ষিকী আগামীকাল ১৯ জুলাই। মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে সাহিত্যের বাইরেও তার অন্যান্য কর্মযজ্ঞ নিয়ে লিখেছেন- জাহাঙ্গীর বিপস্নব

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
হুমায়ূন আহমেদ
নিজেকে শুধু লেখক হিসেবেই পরিচয় দিতেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু সাহিত্যের বাইরে গীতিকার, নাট্যকার, নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমণি' মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। আর তার শেষ উপন্যাস 'দেয়াল' ২০১২ সালে এবং শেষ পরিচালিত চলচ্চিত্র 'ঘেটুপুত্র কমলা' মুক্তি পায় ২০১২ সালে। তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্মই ভক্তদের বিনোদিত করেছে। 'জোছনা ও জননীর গল্প', কুটু মিয়া, মধ্যাহ্ন, কৃষ্ণপক্ষ, গৌরীপুর জংশন, ময়ূরাক্ষী, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, সে আসে ধীরে, অন্যভুবন, আমিই মিসির আলীসহ অনেক পাঠকপ্রিয় সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও খ্যাতি অর্জন করেছে হুমায়ূন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হূমায়ুন আহমেদও আটক হয়েছিলেন। তাকে নির্যাতন করা হয় এবং হত্যার জন্য গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধকে তাই তিনি লালন করতেন চেতনায়। তার লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ। টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে রূপায়িত করেছেন গতানুগতিক ধারা থেকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণে। সেটি ছিল কৃত্রিমতাবর্জিত, সরল, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ। বিটিভির ধারাবাহিক নাটক 'বহুব্রীহি'তে অত্যন্ত শিল্পসার্থকভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি নিয়ে আসেন। এ নাটকেই টিয়া পাখির মুখে 'তুই রাজাকার' সংলাপটি ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক স্বার্থক অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়। এ সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, আলী জাকের, লুৎফুন্নাহার লতা, আফজাল শরীফ, আফজাল হোসেন, আলেয়া ফেরদৌসী, দীপা ইসলাম। ধারাবাহিকের শেষ অংশে দেখা যায় আদর্শবাদী সোবহান সাহেব তার জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন একটি বিষয়। তিনি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে শহীদদের নামের তালিকা প্রস্তুতের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। এর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের তালিকা প্রণয়নের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যে অবিলম্বে শুরু হওয়া উচিত সেই দিকে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তার সহজাত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন সেটিও খুব সঙ্গতভাবেই ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। 'আগুনের পরশমণি' ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য সিনেমা থেকে একেবারে আলাদা ধাঁচের। ঢাকা শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরে গড়ে ওঠে ছবির কাহিনী। এতে ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ নৈপুণ্যে তুলে ধরেন একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন, নারীর ওপর বীভৎস নির্যাতন, গণমনের ক্ষোভ, গেরিলা যুদ্ধ, রাজাকার আলবদরদের ঘৃণিত কার্যকলাপ। আর এ সবই তিনি করেন চোখে আঙুল দিয়ে নয়, অতি নাটকীয় বা আরোপিতভাবেও নয়, সহজ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে। এ ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, গণহত্যার শিকার অসংখ্য বাঙালির মৃতদেহের ওপর ঝরে পড়ে বৃষ্টি। অসাধারণ একটি দৃশ্যকল্প এটি। 'আগুনের পরশমণি'তে প্রধান তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত। 'আগুনের পরশমণি' সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালনাসহ আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এ ছবির জন্য হুমায়ূন আহমেদ কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা এবং প্রযোজক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান। বলা চলে এ ছবির মাধ্যমেই চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে দেন হূমায়ুন আহমেদ। ২০০৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'শ্যামল ছায়া'। ছবির প্রারম্ভেই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসে একদল মানুষ নৌকায় করে মুক্তাঞ্চলের দিকে যাত্রা শুরু করে। এখানে যাত্রাপথের টুকরো ঘটনার ছোট ছোট দৃশ্যের মধ্য দিয়ে হূমায়ুন আহমেদ গ্রামবাংলার মানুষের বীরত্ব, অসহায়ত্ব, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরেন। বড় নৌকাটিতে যে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষরা যাত্রী হয় তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে হূমায়ুন আহমেদ প্রকৃতপক্ষে বাঙালির সে সময়কার অনুভূতি, অভিন্ন স্বার্থ ও আবেগকেই তুলে ধরেন। নৌকায় বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পীতাম্বর, তার অন্ধ পিতা যাদব ও বৃদ্ধ ঠাকুরমা, করিম সাহেব ও তার পুত্রবধূ রাত্রি, ফুলির মা ও ফুলি, মুন্সি মোসলেম উদ্দীন ও তার স্ত্রী বেগম, গৌরাঙ্গ ও তার স্ত্রী আশালতা ও মা পার্বতী, জহির, মাঝি বজলু ও তার সহকারী কালুসহ কয়েকজন নারী ও শিশু। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তাঞ্চলে পৌঁছাতে পারে নৌকাটি। পর্দায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পতাকা। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন ফরিদী, মেহের আফরোজ শাওন, শিমুল, রিয়াজ, স্বাধীন, সৈয়দ আখতার আলি, তানিয়া আহমেদ, আহমেদ রুবেল, ড. এজাজ, শামীমা নাজনীন, জেসমিন পারভেজ। ছবিটি অস্কার পুরস্কারের জন্য সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র শাখায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবেও প্রশংসিত হয় ছবিটি। এ দুটি চলচ্চিত্রই নির্মিত হয় হূমায়ুন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে। লেখক হিসেবে তিনি যেমন সহজ ভাষায় মানব মনের গভীরতম অনুভবকে প্রকাশ করতে পারতেন অনায়াস দক্ষতায়, তেমনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি খুব সহজ, স্বাভাবিক সংলাপ ও দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে গভীর ভাবনা তুলে আনতে পারতেন। সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রের ভাষায়ও তিনি ছিলেন এক, অদ্বিতীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী।