ববিতার দিন-রাত্রি...

দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতা। পারিবারিক নাম ফরিদা আক্তার পপি। প্রায় ৪০০ ছবির এই অভিনেত্রী এখন অভিনয় থেকে অনেকটাই দূরে। চলচ্চিত্রের চলমান পরিবেশে আর অভিনয় করতেও চান না টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই অভিনেত্রী। বেকলমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র পেলেই অভিনয়ে ফিরবেন তিনি। একমাত্র ছেলেকে নিয়েই তার বর্তমান চিন্তা-ভাবনা। ববিতার চলমান সময় এবং চলচ্চিত্রের সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন- আকাশ নিবির

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ফরিদা আক্তার পপি (ববিতা)
চলমান সময়... একমাত্র ছেলে অনিককে নিয়েই এখন আমার সকল ব্যস্ততা। ছেলে পড়াশোনা শেষ করে ইতিমধ্যে দেশের বাইরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরিতে যোগদান করেছে। মাঝে মাঝেই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে বিদেশে যাচ্ছি। আবার কিছুদিন পর ফিরে আসছি। এভাবেই কাটছে আমার চলমান সময়। কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় নিয়ে কথা হচ্ছে। অচিরেই একটি অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামে দেশের বাইরে যেতে হতে পারে। তবে বর্তমানে ফেসবুক বিড়ম্বনায় আছি। আমার নিজের কোনো ফেসবুক আইডি না থাকলেও কিছু অসাধু চক্র আমার নামে ফেসবুক আইডি খুলে মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা খুব দুঃখজনক। নতুন চলচ্চিত্রে... অভিনয় তো আমার পেশা। কিন্তু পেশা হলেও আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা গল্প পছন্দ না হলে কাজ করব না। এখনও প্রতিনিয়ত প্রস্তাব পাচ্ছি। যতদূর জেনেছি আমাকে নিয়ে বিনোদন সাংবাদিক মাজহার বাবু'র 'লালবল' গল্পে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র আমাকে নিয়ে আলাপচারিতা চলছে। গল্পটা আগে তো শুনি, ভালো লাগলে অভিনয় করতে আপত্তি নেই। বিদেশে সম্মাননা... বিদেশের চেয়ে আমার কাছে দেশের সম্মামনা বেশি প্রিয়। কারণ এটি আমার দেশ, এটি আমার মাতৃভূমি। কেননা এই দেশের মানুষের জন্য আমি সম্মানিত হয়েছি। সব থেকে আগে আমার দেশ। আর বিদেশে গিয়ে যখন আমি সম্মাননা পাই তখন আমার কাছে মনে হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক বিরাট স্বীকৃতি। এটি আমাকে নয় এই সম্মান আমার দেশকে দিচ্ছে। এটা আমার কাছে সব থেকে বেশি প্রাপ্তির হয়ে থাকে। সেই থেকে শুরু... প্রথম ছবি নায়ক রাজরাজ্জাক ভাইয়ের ছবির কথা শুনে রাজি হয়েছিলাম। প্রয়াত বিখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হান তার 'সংসার' ছবির জন্য অল্প বয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন। তিনি আমাকে ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব দেন। আমি রাজি ছিলাম না। তারপর মা-বোনসহ পরিবারের সবাই খুব করে বোঝালেন। পরে রাজি হয়েছিলাম। এরপর আড়াই বছর কেটে যায়। এরপর জহির ভাই আমাকে নায়িকা করে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আরও একটি ছবির নাম পরিকল্পনা করেন। ছবিটি করতে গিয়ে খুব অসুবিধায় পড়েছিলাম। কারণ আগের ছবিতে রাজ্জাক ভাই ছিলেন আমার বাবার চরিত্রে। তার সঙ্গে প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে নিজের কাছে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। স্মৃতিগুলো খুব মিস করি এখনও। মধুময় স্মৃতি... স্মৃতির তো শেষ নেই। এই মুহূর্তে একটি ঘটনা মনে পড়ছে, সেটি হলো, নব্বই দশকের শুরুর দিকে আমি খুব ব্যস্ত একজন অভিনয়শিল্পী। এক সন্তানের মা। তা-ও আবার সিঙ্গেল মাদার। অনিকের বাবা যখন মারা যান, তখন ওর বয়স তিন বছর। শুটিংও ফেলে রাখা যাবে না। তবে এর মধ্যে ভালো ভালো ছবি করার প্রস্তাব ছাড়তে হয়েছে। ঢাকার বাইরের শুটিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছু ভাবতে হতো। আর ঢাকায় যেসব ছবির শুটিং হতো, সেগুলো করার ক্ষেত্রেও অনেক চিন্তা-ভাবনা করতাম। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকতাম। কখন আমার ছেলে নিচে নামবে। আর ভাবতাম আমি তো চিত্রনায়িকা ববিতা! এসব ভাবতাম আর নিজে নিজের কাছে হাসি পেত। পছন্দের নায়ক... আমি বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। তবে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আমার স্বপ্নের বা পছন্দের নায়ক ছিল জাফর ইকবাল। সবার সঙ্গে কাজ করেই ভালো লেগেছে। কেউ কেউ আমাকে নিয়ে গর্ব করেছেন। আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক ভাই, ফারুক, সোহেল রানাসহ আরও অনেকের অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব আমাকে আজাও মুগ্ধ করে রেখেছে। ভারতের সৌমিত্র দা'র মতো নায়কের সঙ্গেও আমি কাজ করেছি। চলচ্চিত্রের প্রাপ্তি... যে চরিত্রে কাজ করে দর্শককে মুগ্ধ করতে পারব বলে ধারণা করেছি, সেই চরিত্রের জন্য টাকা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। অভিনয় আমার পেশা। অবশ্যই এখানে আমাকে রোজগার করতে হবে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার সঙ্গে মূল্যও বাড়াতে হবে। তবুও এটা একটি শিল্প। শিল্পী হিসেবে নিজের মনের কিছু খোরাক থাকে। সেই খোরাক মিটায় এমন চরিত্রের জন্য কম্প্রোমাইজ করতেই হবে। আজ তো চলচ্চিত্রে আসার পর এত যশ খ্যাতি আর প্রতিটি সিনেমাপ্রেমি দর্শকরা আমাকে চেনে, ভালোবাসে এমন কি অনেকে শ্রদ্ধাও করে। এর চেয়ে জীবনে আর কি প্রাপ্তি থাকতে পারে। আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, সততার সঙ্গে কাজ করেছি, পরিশ্রম করেছি। এমনও হয়েছে প্রযোজকের আর্থিক দিক বিবেচনা করে আমি অনেক সুপারহিট ছবিতে কাজ করেছি কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নেইনি। সব সময় নিজের চরিত্রটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট... আমাদের দেশের 'মাইলস্টোন', 'গোলাপী এখন ট্র্রেনে', 'নয়নমণি', 'বসুন্ধরা', 'ডুমুরের ফুল', 'আলোর মিছিল', 'বাঁদি থেকে বেগম', 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী', 'দহন' ইত্যাদি ছবিও আমাকে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। আমি সব মিলিয়ে অভিনয় করেছি প্রায় চার শতাধিক ছবিতে। সবগুলো চলচ্চিত্রই আমার টার্নিংপয়েন্ট। কেননা, একটি না হলে অন্যটি হতো না। তবে আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার, উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের অহঙ্কার সত্যজিৎ রায়ের 'অশনি সংকেত' ছবিটি। এই ছবিটি সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে আমাকে পরিচিতি দিয়েছে। বর্তমান সময়ের শিল্পীদের নিয়ে... ইন্ডাস্ট্রি এখন শাকিবনির্ভর। মূল্যায়নের কথা খুব বেশি জানাতে চাচ্ছি না। এসব না বলাই ভালো। অনেকেই বলে থাকেন সিনিয়ররা কেবল সমালোচনা করেন। কেন করেন সেটা তারা উপলব্ধি করেন না। এটা ভালো কোনো কথা নয়। যেখানে রাজ্জাক ভাই ছিলেন সেখানে আলমগীর, জসীম, উজ্জ্বল, সোহেল রানারাও কাজ করেছেন। জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনরা একসঙ্গে ছবিতে অভিনয় করেছেন। শাহরুখ খানের প্রতিদ্বন্দ্বী সালমান-আমির। আসলে সব খানেই একটা গণতন্ত্রের চর্চা থাকা চাই। নতুনদের নিয়ে নির্মাতা ও প্রযোজককে কৌশলী হতে হবে। তাদের জন্য মৌলিক গল্পের চমক জাগানিয়া ছবি বানাতে হবে। রিয়াজ-শাবনূর ও পূর্ণিমার আবারো চলচ্চিত্রে নিয়মিত হওয়া উচিত। এই তিন তারকার জুটি খুব জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তা কোনোদিন ফুরায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যবহার করতে জানলে চিরকালই জনপ্রিয়তা থাকে। অনেক নতুনরা আশা জাগাচ্ছেন। নতুন অনেকের অভিনয়ও ভালো তাদেরও তো একটু সুযোগ প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশই ছবির গল্প চরিত্র নিয়ে না ভেবে পারিশ্রমিক নিয়ে আগে চিন্তা করছেন। এটা কোনো শিল্পীসুলভ আচরণ না।