তারকাদের চোখে বর্তমান টিভি নাটক

অতীতে টেলিভিশন নাটকের সুদিন ছিল। এতে কারও দ্বিমত নেই। তবে বর্তমান টিভি নাটক কেমন হচ্ছে? এ নিয়ে রয়েছে নানা কথা, নানা মত। পক্ষে-বিপক্ষেও রয়েছে যুক্তি। দর্শকের বাইরে নাটকের শিল্পীরাও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেন। কয়েকজন তারকার সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন- মাসুদুর রহমান

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আলী যাকের টেলিভিশন নাটকে এখন আগের মতো সে রকম ভালো গল্প পাওয়া যায় না। বর্তমানে টেলিভিশন নাটকের মান হারিয়ে গেছে। নাটকের সংলাপের গাঁথুনি, চরিত্রের গভীরতা, গল্পের মান আগের মতো এখন নেই। গতানুগতিক নাটক প্রচারিত হয়। এখন অনেক চ্যানেল, প্রচুর নাটক নির্মাণ হচ্ছে। তবে বুদ্ধিদীপ্ততা নেই। ভালোর অভাব। আসলে শিক্ষার অভাব হলে যা হয়। বিশ্ব সংস্কৃতি যোগাযোগে, শিল্প ও সংস্কৃতি উন্নয়নের যে শিক্ষার দরকার তা নেই। সঠিক শিক্ষা না থাকলে কোনো কিছুতেই সাফল্য আসে না। শুধু নাটক নয়, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সকল বিষয়ে প্রচুর পড়তে হবে। আতাউর রহমান সবকিছু সব সময় একই অবস্থায় যায় না। আপ অ্যান্ড ডাউন থাকে। গল্প-উপন্যাসেরও ভালো একটা সময় ছিল। রবীন্দ্র-নজরুলের পর তা নেই। ঠিক একই অবস্থা নাটক-চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের সুন্দর একটা সময় আমরা দেখেছি। পারিবারিক গল্পের চমৎকার নাটক তৈরি হতো। কমেডিও ছিল কিন্তু, এখনকার মতো এত ভাঁড়ামো ছিল না। ঈদের সময় কিংবা বছরের অন্য সময়েও দর্শক টিভি নাটকের জন্য মুখিয়ে থাকতেন। নাটকের গল্প, অভিনয়ে মুগ্ধ হতেন সবাই। নাটকের কিছু কিছু সংলাপ তো মানুষের মুখে মুখে রটে যেত। এখন এসব অতীত। ৩০টির মতো টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি অসংখ্য ইউটিউব চ্যানেল। প্রচুর নাটকে একই গল্প, একই মুখ, কোনো নতুনত্ব নেই। দর্শক এসব পছন্দ করেন না। তারা চান পারিবারিক গল্প। এ জন্যই বিদেশি সিরিয়ালগুলো দর্শক দেখছেন। সেখানে কিছু নেগেটিভ বিষয় থাকলেও দর্শক গ্রহণ করছেন। কিছু ভালো নাটক নির্মাণ হচ্ছে তা খুবই নগণ্য। আবুল হায়াত নাটকের পরিবেশ এখন কমার্শিয়াল হয়ে গেছে। প্রচুর নাটক নির্মাণ হলেও ভালো নাটকের সংখ্যা খুব কম। ঈদ কিংবা বিশেষ দিবস উপলক্ষ ছাড়া অন্য সময়ে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নাটকের প্রতি গুরুত্ব দেন না। নিয়মিত নাটকের প্রতি তাদের মাথা ব্যথা কম। তাই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসায়িক কারণে বিশেষ দিবসের নাটকের প্রতি গুরুত্ব দেন। নাটক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের হাতে, তারা চাইলে ভালো নাটক প্রচার করতে পারেন কিন্তু তা না করে মানহীন নাটক প্রচার করছেন ব্যবসায়িক কারণে। আমার মতে, ভালো নাটক না হওয়ার পেছনে বাজেট স্বল্পতা অনেকটা দায়ী। কারণ টাকা সরাসরি মানের সঙ্গে জড়িত। টাকা কম লগ্নি করলে খুবই কম সময়ে নাটক নির্মাণ করতে হয়। দিন দিন টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও কমছে নাটকের বাজেট। ফলে আশানুরূপ ভালো নাটক হচ্ছে না। বাজেটের স্বল্পতার কারণে নির্মাতাদের মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। নির্মাতারা বৈচিত্র্যময় নির্মাণে ব্যর্থ হচ্ছে। পেশাগত কারণে কম টাকায় তাদের নাটক বানাতে বাধ্য হতে হয়। দুই দিনে যে করতে হতো, তা বাজেট স্বল্পতার কারণে একদিনে করতে হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নাটকের মান খারাপ হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের নাটক তার মান ও গৌরব হারাচ্ছে। নানা জটিলতার মাঝেও ভালো নাটক হচ্ছে কিন্তু গড্ডলিকায় ভেসে যাচ্ছে সে নান্দনিক সৃষ্টিগুলো। প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের নাটক নির্মিত হচ্ছে দর্শকদের জন্য। অথচ সেই দর্শক নাটক দেখছে না অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের কারণে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উচিত মানহীন একশ'টি নাটক প্রচার না করে ভালো মানের দশটি নাটক প্রচার করা। বিজ্ঞাপনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে সহনীয় করা। ইনামুল হক এখন অনেক চ্যানেল, অনেক নাটক, নাট্যকার, নির্মাতা ও অভিনয় শিল্পী কিন্তু আগে তা ছিল না। শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল। তখন অনেক ভালো ভালো নাটক প্রচার হতো এটা ঠিক, তবে এখনো ভালো নাটক নির্মিত হচ্ছে। সবই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। ভালো-মন্দ দুটোই আছে। তবে এখন নাটকে অশুদ্ধ উচ্চারণের মাত্রাটা আমার কাছে বেশি মনে হয়। গল্পের ভিন্নতা কম। ঘুরেফিরে একই শিল্পী অভিনয় করছেন। হাসান ইমাম আমাদের অতীতের নাটকের সুনাম রয়েছে তবে এখনো আমাদের নাটকগুলো ভালো হচ্ছে। অনেক ভালো ভালো নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হয় নিয়মিত। যারা অভিযোগ করেন বর্তমান নাটক ভালো হয় না, আমার মনে হয় তারা আমাদের নাটকগুলো দেখেন না। না দেখেই এমন মন্তব্য করেন। তারা হয়তো ভারতের সিরিয়াল নাটক দেখে অভ্যস্ত। ভারতের চেয়ে আমাদের সিরিয়াল অনেক অনেক ভালো। তবে, তাদের খন্ডনাটকগুলো খারাপ নয়। ভারতের সিরিয়ালে তেমন কোনো বিষয়বস্তু নেই। কড়া মেকআপ, কুটনামী, পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রাধান্যই বেশি দেখানো হয়। মূলত শেখার কিছু নেই। অন্যদিকে আমাদের নাটকে জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। তবে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের লেখা থেকে নাটক কম হচ্ছে। লায়লা হাসান বিটিভির নাটকের মানের উন্নতি হচ্ছে। দর্শক বাড়ছে। কিন্তু বেসরকারি চ্যানেলগুলোর ব্যাপারে দর্শক বরাবরই অসন্তুষ্ট। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় দর্শক বিরক্ত হয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করে অন্যকিছু দেখছেন। অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপন দেখার সময় দর্শকের নেই। নাটক দেখতে বসে যদি আধা ঘণ্টার বিজ্ঞাপন দেখতে হয় তাহলে ধৈর্য্য থাকে কি করে। দেখা যায় ২২ মিনিটের চাংয়ে ১০-১২ মিনিট বিজ্ঞান চালানো হচ্ছে। এসব কারণেই টেলিভিশন নাটকের প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চ্যানেলগুলোতে কিন্তু অনুষ্ঠানের ফাঁকে এত বিজ্ঞান প্রচার হয় না। দিলারা জামান আগে যে নাটকগুলো হতো, তাতে একটা গল্প থাকত, অনেক সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যিনি নাট্যকার থাকতেন তিনি কাজটি করতেন। এখন সময় বদলে গেছে, মানুষের রুচি বদলে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে যদি আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে অন্যায় করা হবে। আমরা খুবই একটি ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো আবার ঠিক হবে। তবে আগের মতো চিন্তা করলে, আগের একটি নাটক দেখার জন্য বাসার ড্রয়িংরুমে জায়গা পাওয়া যেত না। বাড়ির সবাই মিলে নাটক দেখত। এখন সেটা নেই। এখন কেমন নাটক হচ্ছে তা সবারই জানা। এখন কমেডি-রোমান্টিক নাটকই বেশি। যেগুলো অনেক কিছুই আমাদের জীবনের সঙ্গে যায় না। অদ্ভুত ধরনের ব্যাপার-স্যাপারগুলো নিয়ে নাটক তৈরি হচ্ছে। এর কিছু দর্শকও আছে। আর দর্শক তো বিভিন্ন শ্রেণির। সবার চিন্তা ও রুচির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এটা একটা সময় যাচ্ছে, এটা ঠিক হয়ে যাবে। আবার অনেক ভালো নাটকও হচ্ছে। নতুনরা অনেকেই ভালো করছে। সাবেরী আলম ভালো-মন্দ দুটোই। ভালোর সংখ্যাও যেমন বেশি, তেমনই মন্দর সংখ্যাও কম নয়। তবে আমরা কিন্তু ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়তই পরিশ্রম করে যাচ্ছি দর্শকদের ভালো কিছু দেয়ার জন্য। আমি নিজে দেখেছি অনেক নতুন শিল্পীও টানা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। নির্মাতারাও তার সৃষ্টিকে ভালো করার জন্য রাত-দিন খাটছেন। একজন লাইটম্যান, ক্যামেরাম্যান এমনটি একজন প্রডাকশন বয়ও কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করছেন ভালো কিছু করার জন্য। সত্যি বলতে আমাদের মাঝে ভালো কাজের প্রশংসার চেয়ে মন্দ কাজের অভিযোগের মাত্রাটা বেশি কাজ করে। তবে, ইদানিং নাটকে সিনিয়রদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। তানভিন সুইটি আমাদের সময় প্রচারিত ঈদের নাটকের কথা দর্শক এখনো বলেন। নাটকের গল্প, অভিনয়, নির্মাণ সবকিছুই ছিল মনে রাখার মতো। কিন্তু এখনকার নাটক দর্শক দেখার পর ভুলে যান। মজা পান না। ঘুরেফিরে একই গল্পের বারবার উপস্থাপনা। যেন একই নাটক দুইবার দেখছেন দর্শক। ভালো নাটকের সংখ্যা খুবই কম। অন্যদিকে টিভি চ্যানেলগুলো নাটক নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বিদেশি সিরিয়াল প্রচার করে আমাদের কাজের পরিধি কমিয়ে দিচ্ছে। এসব নানা সমস্যার মধ্যে চলছে টিভি নাটক। কীভাবে এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে তা নিয়ে সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। দীপা খন্দকার আগের মতো ভালো অবস্থানে না থাকলেও বর্তমান সময়ের নাটক ততটা খারাপ হচ্ছে না। এখনো ভালো নাটক নির্মাণ হয়। এখন এমন একটি সময় যাচ্ছে যেখানে ভালো স্ক্রিপ্ট পাওয়াই খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। স্ক্রিপ্ট ভালো না হলে ভালো অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করতে চান না। করলেও দর্শক তা গ্রহণ করেন না।