মঞ্চে নতুন নির্দেশক ও নাটকের জোয়ার

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
একা এক নারী
মাসুদুর রহমান টেলিভিশন নাটক থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিলেও দিন দিন সরব হয়ে উঠছে মঞ্চ নাটকে। নাটকের কলাকুশলী আর দর্শকদের পদচারণায় ক্রমেই মুখর হয়ে উঠছে ঢাকার মঞ্চপাড়া। বিগত সময়ের তুলনায় এ বছরে নাট্যাঙ্গনে যেন নতুন নাটকের জোয়ার বইছে। মঞ্চে নতুন নাটকের পাশাপাশি নবীন নির্দেশক আর নতুন শিল্পীদেরও আগমন ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশের নাট্যাঙ্গনে এসেছে ৩০টিরও বেশি নতুন নাটক। চলতি জুলাই মাসেই মঞ্চস্থ হয়েছে বেশ কিছু নতুন নাটক। জুলাই মাসে পালাকার নাট্যদল মঞ্চে আনে নতুন নাটক 'রং লেগেছে' নাটকটি। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার মঞ্চে 'পৌরাণিক পঞ্চরং' শিরোনামে প্রথম অভিনয় করে কলকাতার বনেদি কমেডি নাট্যদল 'দি রয়েল বেঙ্গল থিয়েটার'। এর একশ ত্রিশ বছর পর পালাকার নতুন রূপে এ নাটকটি মঞ্চে আনে। নাটকটির নাট্য নবায়ন, পরিকল্পনা এবং নির্দেশনায় দিয়েছেন আমিনুর রহমান মুকুল। একই সময়ে মঞ্চে আসে ইউনিভার্সেল থিয়েটারের নাটক 'রেনুলতা'। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় আবুল হোসেন। ১০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ মঞ্চে এনেছে 'অপরেরা'। এটি নির্দেশনা দিয়েছেন আশিক রহমান। গত ২৫ জুলাই নাট্যসংগঠন থিয়েটার ফ্যাক্টরি মঞ্চে আনে নতুন নাটক 'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে'। রচনা করেছেন মোহন রাকেশ। অনুবাদে অংশুমান ভৌমিক ও নির্দেশনা দিয়েছেন অলোক বসু। গত ১৯ জুলাই আপস্টেজ মঞ্চে এনেছে 'রাত ভরে বৃষ্টি'। বুদ্ধদেব উপন্যাস থেকে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন সাইফ সুমন। অভিনয় করেছেন প্রশান্ত হালদার, কাজী রোকসানা রুমা এবং রঞ্জন দে সাথী। বাতিঘর নাট্যদল মঞ্চে এনেছে 'হিমুর কল্পিত ডায়েরি'। মুক্তনীলের লেখা ও নির্দেশনায় নাটকটিতে একক অভিনয় করেছেন সাদ্দাম হোসেন। জুলাই মাসের শেষের দিকে থিয়েট্রোন মঞ্চস্থ করে তাদের প্রথম প্রযোজনা 'সিচুয়ানের সুকন্যা'। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সম্রাট প্রামাণিক। 'এম্পটি স্পেস' মঞ্চে আনে নুরুজ্জামান রাজার নির্দেশনায় 'আ নিউ টেস্টিমেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট'। আগস্টের ২ তারিখ মেঠোপথ থিয়েটার মঞ্চে আনে 'পুতুলটিকে দেখে রেখো'। নাটকটি একক অভিনয় করেন শামীমা আক্তার মুক্তা। ৬ জানুয়ারি নাট্যদল এথিক মঞ্চে আনে নতুন নাটক 'আলোর অপেরা'। এটি দলের পঞ্চম প্রযোজনা। নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন অপু শহীদ। ১৬ এপ্রিল ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে এনেছে 'ফিয়ারলেস'। রুমা মোদকের লেখা, নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সামিউন জাহান দোলা। ৫ মার্চ মহড়া থিয়েটার মঞ্চে এনেছে 'বেহুলা আমি এবং সতীত্ব'। এ ছাড়া ২ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ মঞ্চে আনে ইউসুফ হাসান অর্কের নির্দেশনায় 'ম্যান অব লা মানচা'। ২৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ আহমেদুল কবীরের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে 'রসপুরাণ'। ২ মে 'দ্য স্প্যানিশ ট্র্যাজেডি' এবং ৬ মে 'জননী সাহসিকা' মঞ্চে আনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ। ২৯ আগস্ট নাট্যদল চন্দ্রকলা থিয়েটার 'শেখ সাদী'র উদ্বোধনী প্রদর্শনী করে। নাটকটি লিখেছেন অপূর্ব কুমার কুন্ডু। নির্দেশনা ও নামভূমিকায় এইচ আর অনিক। দেশের শীর্ষ মঞ্চনাটকের দল নাগরিক নাট্যাঙ্গনের অভিনয় স্কুল 'নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট অব ড্রামা 'প্রস্তাব' ও 'একই বৃন্তে দুজনা' নামে দুটি নতুন নাটক মঞ্চে আনে। দুটি নাটকের অনুবাদ করেন ড. ইনামুল হক। লাকী ইনামের নির্দেশনায় এ দুটি নাটকে অভিনয় করেন প্রতিষ্ঠানের নতুন শিল্পীরা। নাগরিক নাট্যাঙ্গন আগামী নভেম্বরে মঞ্চে আনছে নতুন নাটক 'ল্যাটোর গান'। ড. রতন সিদ্দিকীর রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন হৃদি হক। আরও বেশ কিছু নতুন নাটক মঞ্চে আসছে। নতুন নাটকের বেশিরভাগ মঞ্চায়নই দেখা গেছে দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। কোনো কোনো নাটকের টিকেট না পেয়ে দর্শককে ফিরে যেতেও দেখা গেছে। চলতি বছরে মঞ্চে আসা বেশ কিছু নতুন নাটক প্রশংসিত হয়েছে। কিছু নাটক তুমুল আলোচনারও জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে মার্চ মাসে প্রদর্শিত হয় শহীদুল জহিরের উপন্যাস অবলম্বনে 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'। একই মাসে উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় কামালউদ্দিন নীল নির্দেশিত নাটক 'স্তালিন'। এর মধ্যে বছরের শুরুতে ১১ জানুয়ারি থিয়েটার আর্ট ইউনিট 'অনুদ্ধারণীয়' নামে নতুন নাটকের মঞ্চায়ন করে প্রশংসিত হয়। বুদ্ধদেব বসুর গল্প থেকে নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন ড. মোহাম্মদ বারী। এ ছাড়া বছরের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চে আনে 'সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা' নামের আরেকটি নাটক। সম্প্রতি সুইডেনে মঞ্চায়িত হয়ে বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে এ নাটকটি। আনিকা মাহিনের লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন রোকেয়া রফিক বেবী। ফ্রান্স অ্যাম্বাসির প্রযোজনা এবং মণিপুরী থিয়েটার ও হৃৎমঞ্চের সহযোগিতায় গত ১ ফেব্রম্নয়ারি মঞ্চে আসে 'হ্যাপি ডেইজ'। স্যামুয়েল বেকেটের লেখা এবং শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় নাটকটিতে একক অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা। মঞ্চ নির্মাণ করেছেন শাহনাজ জাহান, সহযোগিতায় আসফিকুর রহমান ও হাসান আলী। আলোক প্রক্ষেপণে আসলাম অরণ্য। সঙ্গীত প্রক্ষেপণে হুমায়ুন আজম রেওয়াজ। স্টেজ ম্যানেজার পারভেজ সরকার। ১৯ এপ্রিল নতুন নাট্যদল তাড়ুয়া মঞ্চে এনেছে 'লেট মি আউট'। রুনা কাঞ্চনের লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন বাকার বকুল। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা আসলাম অরণ্য, সঙ্গীত পরিকল্পনা রবিউল ইসলাম শশী ও ইসমাইল পাটোয়ারী। পোশাক পরিকল্পনা শাহনাজ জাহান। কোরিওগ্রাফি ফরহাদ শামীম। দ্রব্যসামগ্রী মো. শামিম শেখ। প্রযোজনা সমন্বয়ক ইসতিয়াক হোসাইন। ২৩ মার্চ নাট্যচক্র মঞ্চে আনে 'একা এক নারী'। দেবপ্রসাদ দেবনাথের নির্দেশনায় নাটকটিতে একক অভিনয় করেছেন তনিমা হামিদ। দারিও ফো ও ফ্রাংকা রামের লেখা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুস সেলিম। ৩০ এপ্রিল লোক নাট্যদল মঞ্চে এনেছে 'আমরা তিনজন'। বুদ্ধদেব বসুর গল্প অবলম্বনে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন লিয়াকত আলী লাকী। জাকির তালুকদারের ছোটগল্প 'বেহুলার দ্বিতীয় বাসর' অবলম্ব্বনে নির্দেশনা দিয়েছেন মেহেদী তানজীর এবং একক অভিনয় করেছেন লাবণী আকতার। মঞ্চে নতুন নাটক নিয়ে নাট্যব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হক তারার মেলাকে বলেন, 'এ বছরটিকে মঞ্চ নাটকের বছর বলা যেতে পারে। গত নয় মাসে অনেকগুলো নতুন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তার প্রায়গুলোই প্রশংসিত হয়েছে। এসব নাটকের নির্দেশক ও অভিনয় শিল্পীদের অধিকাংশই নতুন। আসলে নতুনেরা উদ্বুদ্ধ হয়ে মঞ্চে ভিড়ছে। অভিনয় স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ উদ্যোগে মঞ্চে কাজ করছে। মঞ্চ নাটকের প্রতি তরুণদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। নতুনরা চমক দেখাচ্ছে। সব কিছু মিলে মঞ্চ নাটকের বর্তমান পরিবেশ খুব ভালো। চলতি বছরের একাধিক নাট্যাৎসব হয়েছে এবং সামনেও উৎসব আছে। চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে 'গঙ্গা-যমুনা নাট্যাৎসব'। এখানেও নতুনদের নাটক প্রদর্শীত হবে।' নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'দর্শক চান সুস্থ বিনোদন। যা শিক্ষণীয়, বাস্তবসম্মত। যে বিনোদনের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের ও সমাজের নানা বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়। দর্শক তা মঞ্চে খুঁজে পান। আগের চেয়ে এখন মঞ্চের অবস্থা অনেক ভালো। নতুন নতুন নাটক ও নতুন দল আসছে এটা খুবই আশাপ্রদ। অন্যবারের চেয়ে এবারে বিভিন্ন ধরনের নতুন নাটকের সংখ্যা বেশি। তবে এখানে টিভি নাটকের মতো পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশে মঞ্চ নাটক করে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি সম্ভব হতো তাহলে মঞ্চের মান আরও উন্নত হতো। নতুনদের আরও পাওয়া যেত।'