একজন 'রাবেয়া'র কথা...

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়ে আসছে। এ দেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো। যার প্রায় সবই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের কথা উঠলেই দেশের অন্যতম অভিনেত্রী বন্যা মির্জার নাম আসে। তিনি এ পর্যন্ত পাঁচটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। যার সবই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। মুক্তিযুদ্ধ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন তিনি মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত 'শরৎ ৭১'-এ। সময়টা ছিল ২০০০ সালে। এরপর তানভীর মোকাম্মেলের 'রাবেয়া', বদরুল আনাম সৌদের 'খন্ডচিত্র ৭১', মাসুদ আখন্দের 'পিতা' ও 'হেডমাস্টার'। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন বন্যা মির্জা।

প্রকাশ | ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মাসুদুর রহমান
বন্যা মির্জা
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীচিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া যে কোনো বাঙালি অভিনেত্রীর জন্যই গর্বের। আবার অভিনীত সব চলচ্চিত্রই যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের তাহলে তো পরম স্বার্থকতা। এমন ভাগ্য ক'জনার হয়! প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। কিন্তু এমনটিই হয়েছে অভিনেত্রী বন্যা মির্জার বেলায়। তার অভিনীত প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রই মুক্তিযুদ্ধের। বন্যা মির্জা বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গর্ব ও অহংকার। আর সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে কাজ করাটা প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর জন্যই সৌভাগ্যের। সত্যিই অভিনেত্রী হিসেবে আমি সৌভাগ্যবতী। আমার অভিনীত সব চলচ্চিত্রই মুক্তিযুদ্ধের। ভাবতে ভালোলাগে। 'মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গর্ব ও অহংকার। তবে 'হেডমাস্টার' ছবিটি পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের বলা যায় না। এ ছবির গল্পটি মুক্তিযোদ্ধার।' এ পর্যন্ত পাঁচটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বন্যা মির্জা। যার সবই মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত 'শরৎ ৭১'-এ। সময়টা ছিল ২০০০ সালে। এরপর তানভীর মোকাম্মেলের 'রাবেয়া', বদরুল আনাম সৌদের 'খন্ডচিত্র ৭১', মাসুদ আখন্দের 'পিতা' ও 'হেডমাস্টার'। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন বন্যা। ২০১২ সালে মাসুদ আখন্দ নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি 'পিতা'। ছবির গল্পে জলিল একজন বিপত্নীক কামার, যে তার মেয়েকে বাঁচাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন। ছবিতে জলিলের স্ত্রী কুসুমের চরিত্রে অভিনয় করেন বন্যা মির্জা। এর আগে ২০০৮ সালে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ছবি 'রাবেয়া'য় অভিনয় করেন তিনি। এতে মুক্তিযোদ্ধার বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বন্যা। ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবু সাঈদ বাবু। আলোচিত এ ছবিটি পস্নট, স্টোরি টেলিং, সংলাপ, পরিমিতিবোধ সব মিলিয়ে বেশ পরিমার্জিত। এ সিনেমার গল্পে দেখা যায়- যুদ্ধের সময় এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করছিল দুই এতিম বোন রাবেয়া ও রোকেয়া। দুজন তাদের এক চাচার বাসায় থাকে। চাচা এমদাদ কাজী মুসলিম লীগের নেতা এবং পরবর্তী সময়ে চরম পাকিস্তানপন্থি। রাবেয়া-রোকেয়ার একমাত্র ভাই খালেদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। একদিন এক গেরিলা অভিযান চালানোর সময় খালেদ শহীদ হন। পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাপ্টেনের নির্দেশে খালেদের মৃতদেহ নদীর তীরে ফেলে রাখা হয়। এলাকার চেয়ারম্যান, শান্তি কমিটির লিডার এমদাদ কাজী আদেশ জারি করেন, কেউ যেন খালেদের লাশ কবর দেওয়ার সাহস না দেখায়। কিন্তু এক রাতে ভাইকে কবর দিতে বেরিয়ে আসে রাবেয়া। ধরা পড়ে যায় রাবেয়া। এমদাদ রাবেয়াকে ভর্ৎসনা করেন। চুপ করে থাকে না রাবেয়াও। প্রতিবাদ করে নিজের পক্ষে যুক্তি দেখায়। ১০৫ মিনিটের এ সিনেমাটিতে কোথাও উচ্চকিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় সচরাচর যে মেলোড্রামা থাকে, এখানে তা একেবারেই নেই। এক ধরনের নির্লিপ্ত, নৈর্ব্যক্তিক অবজারভেশনের মধ্য দিয়ে পরিচালক ক্যানভাসটাকে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধ সবই আছে, কিন্তু সবকিছুই একটা লজিক্যাল ডেকোরেশনে বিন্যস্ত। রাবেয়া চলচ্চিত্রটিই ভালোলাগার শীর্ষে রেখেছেন বন্যা। বন্যা বলেন, 'সব চলচ্চিত্রই আমার কাছে ভালো লেগেছে। তবে 'রাবেয়া' চলচ্চিত্রের গল্পটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। এখানে নিজেকে একটু অন্যরকমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এটি আমার সারা জীবন মনে থাকবে। বন্যার বাবা মির্জা ফারুক একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেই বড় হয়েছেন বন্যা। অভিনয়ে এসেও তাই মুক্তিযুদ্ধের নাটক-চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে কি মুক্তিযুদ্ধের বাইরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন না তিনি। এমন প্রশ্নের জবাবে এ অভিনেত্রী বলেন, 'পরিচালকরা আমার কাছে এ ধরনের ছবির প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, গল্প ও চরিত্র পছন্দ হওয়াতে অভিনয় করেছি। এ ধরনের কাজের প্রতি আগ্রহ থাকে এটা ঠিক, তবে অন্য গল্পের চলচ্চিত্রে কাজ করব না এমনটি নয়। ভালো প্রস্তাব পেলে হয়তো এর বাইরেও আমাকে দেখা যাবে। আমি বলব না মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের বাইরে কাজ করব না।' বন্যা মির্জা অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধেরই নয়, সরকারি অনুদানের। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র 'ঘর গেরস্থি'তে কাজ করছেন বন্যা। হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্প অবলম্বনে ও আকরাম খানের চিত্রনাট্যে এটি নির্মাণ করছেন মাসুদুর রহমান রামিন। এটিও সরকারি অনুদানের। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন আরমান পারভেজ মুরাদ। ছবিটির কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে জানান বন্যা। চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও খুব কম কাজ করেন এ অভিনেত্রী। পর্দার চেয়ে ব্যস্ত থাকেন মঞ্চে। তিনি বলেন, 'অভিনয়টাকে মনে প্রাণে ভালোবাসি। তাই মঞ্চে নিয়মিত। বলতে গেলে মাসের ত্রিরিশ দিনই মঞ্চের সঙ্গে কাটাই। নিত্যনতুন নাটক নিয়ে কাজ করি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়, অভিনয়ের শিকড় হচ্ছে মঞ্চ। মঞ্চের অভিজ্ঞতার শেষ নেই। পাশাপাশি এটিও সত্য, টেলিভিশন নাটকে কাজ কম করছি। বছরে একটা/দুটা কাজ করা হয়। এর বেশি নয়। কখনো সময় মিলে না, কখনো চিত্রনাট্য মনে ধরে না। তারপরেও টুকটাক কাজ করার চেষ্টা করছি।' এবারের বিজয় দিবস উপলক্ষে 'ফসিলের কান্না' নাটকে দেখা যাবে এই সুঅভিনেত্রীকে। মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নাটকটি বিজয় দিবসের রাতে দেশ টিভিতে প্রচারিত হবে। গল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক ছাত্রী বন্যা। একই বিভাগে তার সহপাঠী অভিনেতা ওমর আয়াজ অনি। ভাস্কর্য তৈরির কাজে একদিন তারা একটি গাছের গুঁড়ি কিনে আনেন। এর পর ঘটে নানা ঘটনা।