ডিজিটাল পস্নাটফর্ম

অশালীন ভাষায় ঠাসা

প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

রায়হান রহমান
ঢাকা মেট্রো ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্যে অপি করিম
নাটক, সিনেমা বা গানের ভাষা সামগ্রিকভাবেই মানুষকে প্রভাবিত করে। চলচ্চিত্রের জন্য আনুষ্ঠানিক সেন্সর বোর্ড ও টিভি নাটকের জন্য অনানুষ্ঠানিক সেন্সর কর্তৃপক্ষ (প্রিভিউ বোর্ড) থাকায় ভাষার ব্যবহারে নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা সর্তক থাকেন। ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ি নির্দেশনা থাকায় এখানেও খুব বেশি অশালীন সংলাপ চোখে পড়ে না। তবে একেবারে ছন্নছাড়া ওয়েবভিত্তিক ডিজিটাল পস্নাটফর্মগুলো। নিজস্ব ওয়েব স্ট্রিমিং সার্ভার থাকায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই নির্মাণ হচ্ছে ওয়েব সিরিজগুলো। নির্মাণ শৈলী নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এসব ওয়েব সিরিজে অশ্রাব্য ভাষার সংলাপ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। এর কুফল পড়ছে বর্তমান প্রজন্মের ওপর, বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তরুণরা। যদিও সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে সংলাপের সাবালক ভাষা কিংবা শিল্পের স্বাধীনতা বলে ব্যাখ্যা দিলেও, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তা বড়ই বেমানান। অবস্থা এমন হয়েছে, ওয়েব মানেই অশ্রাব্য ভাষা ও অবাদ যৌনতার দৃশ্য। প্রচারিত প্রতিটি ওয়েব সিরিজের সঙ্গে এ কথার মিলও খুঁজে পাওয়া যাবে। বাংলা ভাষার ওয়েব সিরিজের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইট হলো 'হইচই অরিজিনাল'। সম্প্রতি এ সাইটটি নিজস্ব প্রযোজনায় বেশ কয়েকটি সিরিজি প্রচারে এনেছে। তারমধ্যে 'মন্টু পাইলট, গোরিয়া হাটের গ্যাংলস ও আস্তে লেডিস' অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়েছে। মন্টু পাইলটের গল্প সাজানো হয়েছে পতিতালয় নিয়ে। তরুণীদের জোড় করে ধরে এনে পতিতাবৃত্তি করানোসহ নানা কায়দায় ক্লায়েন্ট জোগাড় করার সম্যক ধারণা এখানে দেখানো হয়েছে। মূলত মন্টু পাইলটের কাজ হলো বিভিন্ন এলাকা থেকে সুন্দরী নারী ধরে আনা। গল্পটা নতুন না হলেও এর প্রতিটি সংলাপ দর্শককে অবাক করেছে। যৌন উত্তেজনায় স্স্নাং শব্দ ব্যবহার, নারীর গতর নিয়ে অশ্রাব্য মন্তব্যসহ নানা অভিযোগে বিদ্ধ এ সিরিজটি। রুচিশীল মানুষ মাত্রই এসব সিরিজ থেকে দূরে থাকবেন। সঙ্গে অবাদ মাদক সেবন দেখানো হয়েছে এ সিরিজে। এমনকি দেখানো হয়নি স্বাস্থ্যঝুঁকির সতর্কতামূলক কোনো বার্তা। 'আস্তে লেডিস' নামের আরও একটি সিরিজের একই দশা। বিউটি পার্লারের টাকা জোগাড় করতে তিন কন্যা নামেন ডাকাতি করতে। সেখানেও রয়েছে রগরগে দৃশ্য ও অশ্রাব্য ভাষা। বিন্দুমাত্র কাটছাঁট না করেই এসব সিরিজ প্রকাশ্যে আনায় সম্প্রতি ভারতীয় আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। 'গোরিয়া হাটের গ্যাংলস' কমেডি ধরনের সিরিজ হলেও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সাবলীলভাবেই বাজে শব্দ ব্যবহার করেছেন। এসব নিয়ে রীতিমত বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে গণমাধ্যমেও। ফলে ওয়েব পস্নাটফর্মে সেন্সর ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত; এমন দাবি তুলছেন অনেকেই। ওয়েব সিরিজের নিয়মিত দর্শক শাকিল রহমান তারার মেলাকে বলেন, 'নেটফ্লিক্স, আমাজান প্রাইম ও হইচই পস্নাটফর্মে যেসব ওয়েব সিরিজ প্রদর্শিত হচ্ছে তার অনেকগুলোতে পর্নোগ্রাফির কন্টেন বিদ্যমান। অশালীন অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে ভাষার ব্যবহারও হয়েছে নিচু মানের। এগুলো আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও নৈতিকার পরিপন্থি। এ ধরনের ওয়েব সিরিজ নির্মাণ ও প্রদর্শনের লাগাম না টানলে সামাজিক ও অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে সমস্যা সৃষ্টি করবে। অনেক ওয়েব সিরিজের ইঙ্গিতধর্মীয় বিষয়াদিতে আঘাত হানার মতো।' শাকিল রহমানের মতো সুশিল সমাজের অনেকেই প্রশ্ন তোলেছেন, যেখানে টিভি-সংবাদপত্র ও সিনেমার প্রতি নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে ওয়েব সিরিজ বাদ যাবে কেন? নেটফ্লিক্সে ছবি লাস্ট স্টোরিসে কিয়ারা আদভানি অভিনীত একটি দৃশ্য দেখা গিয়েছে, নায়িকার শরীরে মেহনযন্ত্র, আর তার দাদির হাতে রিমোট কন্ট্রোল। প্রৌঢ় দাদি সেটা দিয়ে টেলিভিশন চালানোর চেষ্টা করতেই নায়িকা হয়ে উঠলেন উত্তাল। বড় পর্দার জন্য বানানো হলে হয়তো এ দৃশ্য কেটে বাদ দিত সেন্সর বোর্ড। কিন্তু অনলাইন দুনিয়া অবাধ। এদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ অনলাইন কনটেন্টের ওপর নিজেদের মতো সেন্সরশিপ আরোপের চেষ্টা করছে। সম্প্রতি জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ গেম অব থ্রোনসের ছয় মিনিট বাদ দিয়ে প্রচার করেছিল চীন। সেক্রেট গেমসে রাজনীতিবিদ রাজীব গান্ধীকে নিয়ে একটি অশালীন সংলাপ বলার কারণে থানায় অভিযোগ করেছেন এক রাজনীতিক। এমনকি কলকাতার ওয়েব ধারাবাহিক দুপুর ঠাকুরপোর ২য় মৌসুমে অপেশাদার আচরণের দোহাই দিয়ে কাজ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রী। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিটি দেশের উচিত নিজেদের মতো করে এক ধরনের সেন্সরশিপ নীতিমালা তৈরি করা। সব দেশই সেটা করে। কেননা, ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য সবকিছুকে বিক্রির উপকরণ করে তুলতে পারেন। তবে এও মাথায় রাখা দরকার, সেন্সরশিপ আরোপ করতে গিয়ে সংকীর্ণ পর্যায়ে চলে গেলে সেটা ভালো হবে না। উদারতারও দরকার আছে। তবে পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।