বোহেমিয়ান এক রকস্টার

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

জাহাঙ্গীর বিপস্নব
জেমস
মাহফুজ আনাম জেমস। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রের নাম। কিন্তু তার নামের যেন কোনো শেষ নেই। ভক্তদের কাছে তিনি 'গুরু' নামে পরিচিত। তার ব্যান্ডের নামের সঙ্গে মিল রেখে 'নগরবাউল' বলেও ডাকেন সংগীত পিপাসুরা। আবার 'বোহেমিয়ান রকস্টার' উপাধিতেও ভূষিত তিনি। এত পরিচয়, এত জনপ্রিয়তা- কোনো কিছু নিয়েই উচ্ছ্বাস নেই তার। সর্বদাই গম্ভীর মুখে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায় তাকে। তবে গান কিংবা স্টেজ শোর ক্ষেত্রে বদলে যায় জেমসের চোখমুখ। গম্ভীরতার খোলস থেকে বেরিয়ে অন্যরকম এক উন্মাদনায় মেতে ওঠেন তিনি। আর সেই উন্মাদনায় উন্মাতাল এক ঝংকারে বুঁদ হয়ে ওঠেন ভক্ত-শ্রোতারা। তাদের কাছে জেমস মানেই যেন বাড়তি বিনোদন, ভিন্নমাত্রার উচ্ছ্বাস। নগরবাউল জেমস বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব সুর ও গায়কিতে তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছেন কয়েক দশক ধরে। আবার তার গান সর্বজনীনও। সে জন্যই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নন্দিত হয়েছে তার সুরের মূর্ছনা। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এভাবেই ভক্ত-শ্রোতাদের মাত করে আসছেন এ তারকা। কতটি গান করেছেন এ যাবত? কতগুলো স্টেজ শো করেছেন- গুণে শেষ করতে পারেন না তিনি। শুধু তাই নয়, এক জীবনে কতগুলো পুরস্কার অর্জন করেছেন, সেটাও তিনি বলতে পারলেন না। সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো সেরা গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন এ নগরবাউল। ২০১৭ সালের ছবি 'সত্তা'র 'তোমার প্রেমে অন্ধ আমি' শিরোনামে গানটির জন্য সেরা গায়ক হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে তিনি সৈকত নাসির পরিচালিত 'দেশা- দ্য লিডার' ছবিতে গান গেয়ে ২০১৪ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন। তবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মতো বড় কোনো অর্জনই যেন ভাবের কোনো পরিবর্তন এনে দিতে পারে না তার। এমনকি প্রচার-প্রচারণার বিষয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। পছন্দ করেন না অহেতুক কথা-বার্তাও। গান নিয়েই যেন তার সব চিন্তাচেতনা। সুর, লয়, তালই যেন তার একমাত্র ধ্যান-ধারণা। প্রচার বিমুখ এই মানুষটি এখনো আগের মতো নিয়মিত গান গেয়ে যাচ্ছেন। সব ধরনের গান দিয়েই শ্রোতাদের মোহিত করে তুলছেন প্রতিনিয়ত। অ্যালবাম, স্টেজ শো, টিভি শো, বিদেশ কনসার্ট, ঢালিউড-বলিউডে পেস্ন-ব্যাক- সবখানেই সরব উপস্থিতি তার। করপোরেট এই সময়ে যখন খ্যাতি আর সুনামের পেছনে ছুটছে পৃথিবী তখন স্রোতের বিপরীতে নিজেকে নিয়ে খুশি একজন নগরবাউল, আত্মকেন্দ্রিক এই নগরবাউলের সব ভালোবাসা শুধু ভক্তদের জন্য। এ জন্যই হয়তো ভক্তের ভালোবাসায় ছুটে যান হোসেনপুর, কখনো ইন্ডিয়া, কখনো বা উড়োজাহাজের কটপিটে। সংবাদ মাধ্যম বিমুখী এই মানুষটার কাছে নামকরা সাংবাদিকরা সময় না পেয়ে বারবার হতাশ হয়েছেন, অথচ কত সবালীলভাবে তিনি ভক্তদের কাছে টেনে নিয়েছেন, ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন বারবার! 'ভক্তরা আছে বলেই আমি জেমস' বলে নিজেকে শুধু আমাদের জন্যই বিলিয়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের বরেণ্য এই রকলিজেন্ড। \হজেমসের ব্যান্ড (ফিলিংস ও নগরবাউল) থেকে প্রকাশিত অ্যালবামগুলো হচ্ছে- স্টেশন রোড, জেল থেকে বলছি, নগরবাউল, লেইস ফিতা লেইস ও দুষ্ট ছেলের দল। আর একক অ্যালবামের মধ্যে আছে অনন্যা, পালাবে কোথায়, দুঃখিনী দুঃখ করো না, ঠিক আছে বন্ধু, আমি তোমাদেরই লোক ও জনতা এক্সপ্রেস ইত্যাদি। জেমসের এসব গানের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে- যা অন্যদের গানে নেই। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জেমসকে নিয়ে গেছে সব রকম শ্রোতার কাছে। ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষ, শহর-গ্রাম- সবার কাছে জেমস হয়ে উঠেছেন গুরু। এর কারণ জেমসের গানের সর্বজনীনতা। কনডেম সেলে আটক ফাঁসির প্রহর গুনতে থাকা আসামি, ভাড়ায় খাটা পেশাদার খুনি, গ্রামের হাটে মলম বিক্রি করা মান্নান মিয়া, গার্মেন্টসে কাজ করা নারী শ্রমিকরা (সেলাই দিদিমণিরা), সব হারা একজন জুয়াড়ি, লিডার (নেতা), নাটোর স্টেশন রোডের দরিদ্র পতিতা জরিনা বিবি, মাতাল শারাবী, রিকশাওয়ালা, গ্রামের মেয়ে হুমায়রা, রাজার দরবারের নর্তকী মীরা বাই, বিরোধী দলের অবরোধের সময়ে প্রেম কিছুই বাদ নেই জেমসের গানের বিষয় থেকে। গানের বিষয় নির্বাচনে জীবন সম্পর্কে তার গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিচিত্রময়তাই প্রশ্রয় পেয়েছে। তার সুরেও আছে বৈচিত্র্য- যা ছুঁয়ে যায় নগর, গ্রাম, কলকাতা, বলিউডসহ সব রকমের শ্রোতাদের। জেমস হতাশায় ডুবে থাকা মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। হতাশ হয়ে কেউ দিনের পর দিন মনমরা হয়ে থেকেছে। কেউ মাদকের দিকে হাত বাড়িয়েছে, কেউ আত্মহত্যা করেছেন; কিংবা করেছে ভয়াবহ অপরাধ। এই হতাশ মানুষগুলোর দিকে জেমস হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রগাঢ় মমতায় গেয়েছেন, 'নীরবে অভিমানী নিভৃতে করেছ তিলে তিলে নিজেকে শেষ? কেন বলো পৃথিবীতে কেউ কারও নয়, হয়ে গেছে ভালোবাসা নিঃশেষ। বন্ধু ভেঙে ফেলো এই কারাগার খুলে দাও খুলে দাও এ হৃদয়ে প্রেমেরই দ্বার'। অথবা 'দুঃখের পৃষ্ঠা উল্টে দেখো স্বপ্নের বাগিচা, ঘরে বসে থেকে লাভ কি বলো? এসো হাতে হাত রাখি এসো গান করি। দুঃখিনী দুঃখ করো না... দুঃখিনী...দুঃখিনী'। নিজেকে একজন দুঃখী মানুষ হিসেবে তুলে ধরে আশার আলো দেখিয়ে বলছেন, 'দুঃখ আমার সঙ্গে আছে, তবু দেখো দুঃখী আমি নইতো।...কিসের এত দুঃখ তোমার। সারাক্ষণ বসে বসে ভাবছ? পৃথিবীতে বলো বাঁচবে কদিন। সময়টা তো বড় অল্প।'