'ভাষার বিকৃতি পুঁজি করে অনেকে ফায়দা লুটছেন'

গুণী অভিনেতা আবুল হায়াত। পাঁচ দশক ধরে অভিনয় করে চলেছেন। এখনো নিয়মিত অভিনয় করছেন নাটক ও চলচ্চিত্রে। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনাও করেন। শুধু তাই নয়, লিখেনও নিয়মিত। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বইমেলাতে প্রকাশ পাচ্ছে তার তিনটি বই। লেখালেখি, অভিনয়, পরিচালনা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তারার মেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মাসুদুর রহমান

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বইমেলায় তিন বই... এবারের বইমেলাতে আসছে তিনটি বই। দুটি গল্পের, একটি টিভি নাটকের সংকলন। গল্পের দুই বই 'টাইম ব্যাংক' ও 'আষাঢ়ে' প্রকাশ করছে প্রিয় বাংলা প্রকাশনী। পাঁচটি টিভি নাটকের সংকলন নিয়ে নাটকের বই 'প্রিয় অপ্রিয়' প্রকাশ করছে বইপুস্তক। তিনটি বইয়ের একটির প্রচ্ছদ করেছে আমার বড় মেয়ে বিপাশা হায়াত। আমার বেশির ভাগ বইয়ের প্রচ্ছদ বিপাশাই করেছে। এবার ও দেশের বাইরে থাকায় একটি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছে। যখন লেখা হয়... অবসর পেলেই লিখতে বসি। আসলে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করি। আনন্দ পাই, তাই লিখি। এগুলোকে লেখা বা সাহিত্য বলে না। তবুও লিখি নিজের মন থেকে। কিছু পাঠকরাও আমার বইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখির অভ্যাসটা ধরে রাখতে চাই। লেখালেখির শুরু... সেই ইন্টারমিডিয়েটে পড়া সময় থেকেই লেখালেখি করি। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখার অভ্যাসটা এখনো রয়েগেছে। প্রথম বই প্রকাশ হয়েছিল আজ থেকে ২৭/২৮ বছর আগে সম্ভবত বাংলা ১৩৯৮ সালে। সেটি ছিল উপন্যাসের বই 'আপস্নুত মরু'। এ পর্যন্ত আমার ২৯টি বই প্রকাশ হয়েছে। এবারের তিনটি দিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২। গল্প, উপন্যাস, নাটকেরসহ নানা ধরনের বই প্রকাশ হলেও কখনো কবিতার বই প্রকাশ হয়নি। কখনো চেষ্টাও করিনি। \হ লাইট-ক্যামেরায়... তৌকির আহমেদের নতুন একটি ধারাবাহিকে কাজ করছি। নাটকের নাম 'রপালী জ্যোসনায়'। ফ্যামিলি ড্রামা। দর্শক এখন রোমান্টিক-কমেডি নাটক দেখতে দেখতে বিরক্ত। এসব নাটক আর তারা চান না। তাই ইদানীং ফ্যামিলি ড্রামা নির্মাণের সংখ্যা বাড়তেছে। এসব নাটক বরাবরই দর্শক পছন্দ করেন। বিভিন্ন চ্যানেলে কয়েকটি ধারাবাহিক নাটক প্রচার হচ্ছে। এসবের বাইরে খন্ড নাটকেও কাজ করছি। বিশেষ দিবস উপলক্ষে এখন খন্ড নাটকের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। তাই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসায়িক কারণে বিশেষ দিবসের নাটকের প্রতি গুরুত্ব দেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়... ১৯৭২ সালে ঋত্বি কুমার ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমার সিনেমায় কাজ শুরু। এরপর ভিন্নধারা ও বাণিজ্যিক ধারা অনেক ছবিতে কাজ করেছি। সর্বশেষ মুক্তিপায় তৌকির আহমেদের 'ফাগুন হাওয়ায়' চলচ্চিত্র। এরপর মীর সাব্বিরের একটি সিনেমায় কাজ করেছি কিন্তু নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। আরেকটি ছবির প্রস্তাব এসেছিল। গল্প, চরিত্রও অনেক ভালো ছিল কিন্তু বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছে। কারণ এর শুটিং ছিল অনেক দুর্গম এলাকায়। এই বয়সে এই শরীর নিয়ে সম্ভব ছিল না। তাই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলন... মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মিত হয়নি বললেই চলে। আমার জানা মতে দুটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে। এর একটি গত বছরে মুক্তি পাওয়া তৌকির আহমেদের 'ফাগুন হাওয়ায়' অন্যটি জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া'। তবে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে টিভি নাটক মোটামুটি হয়েছে। আসলে এসব কাজ করতে অনেকেই সাহস করেন না। অন্যদিকে বাজেটেরও একটা বিষয় থাকে। এসব কাজ করতে গেলে অনেক খরচও হয়। যে বাজেট দেয়া হয় তাতে হয় না। নাটকে ভাষার বিকৃতি... এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, নাটকে ভাষার বিকৃতি হচ্ছে। যে ভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সেই ভাষার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। নাটকে প্রমিত ভাষার অভাব অনেক। আগে আমরা যারা টিভিতে নাটক করতাম তখন শতভাগ প্রমিত ভাষার ব্যবহার ছিল। বাবা-মায়েরা সন্তানদের বলতেন বিটিভির নাটক দেখতে। কারণ সেখান থেকে শুদ্ধ ভাষা শেখা যেত। এখন অভিভাবকরা সন্তানদের টিভি দেখতে নিষেধ করেন। নাটকে শুদ্ধ ভাষার পরিবর্তে যাচ্ছেতাই ব্যবহার হচ্ছে। অনেকে এটাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটছেন। নাটক যেহেতু স্বাধীনতার জয়গা- তাই যার যা ইচ্ছে তাই করছেন। তাদের মধ্যে রুচি ও দায়িত্ববোধ নেই। তবে এটা বন্ধে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিতে পারে। তারা যদি বলেন, নাটকে ভাষার বিকৃতি হলে সে নাটক প্রচার করা হবে না। তাহলে অনেক পরিবর্তন আসবে। ভাষার ব্যবহারে উদ্যোগ... প্রমিত ভাষা ব্যবহারে আমাদের সচেতনতার অভাব। পরিবার থেকেই শুরু হচ্ছে এটা। সন্তানদের শুদ্ধ বাংলা বলার অভ্যাস করছি না। স্কুলে যে শিক্ষকের কাছ থেকে এক শিশু পড়তে-লিখতে শিখছে সে নিজও জানেন না ভাষার ব্যবহার। একই অবস্থা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানেও শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই। প্রমিত বাংলা ভাষা থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে। আঞ্চলিকতাকে অস্বীকার করছি না। নিজের নিজস্ব ভাষা থাকবে। তবে শুদ্ধ ভাষা ভুলে গেলে তো চলবে না। যেমন একজন লোক ঘরে যে পোশাক পরে, সেই পোশাক পরে কি বাইরে বের হন? ঘরের পোশাক পরে কি কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া যায়? এটা যেমন বেমানান, তেমনই ঘরের বাইরে, বিভিন্ন পরিবেশে অশুদ্ধ বাংলা ভাষা কিংবা বাংলার সঙ্গে ইংলিশ মিশিয়ে বাংলিশ ব্যবহার অনুচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন এসবেই অভ্যস্ত হচ্ছি। এটা জাতির জন্য হতাশা ছাড়া কিছু নয়। \হনাটকে বাজেট ও মান... ভালো নাটক না হওয়ার পেছনে বাজেট স্বল্পতাই অনেকটা দায়ী। কারণ টাকা সরাসরি মানের সঙ্গে জড়িত। বাজেটের স্বল্পতার কারণে নির্মাতাদের মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। পেশাগত কারণে কম টাকায় তাদের নাটক বানাতে বাধ্য হতে হয়। নানা জটিলতার মাঝেও ভালো নাটক হচ্ছে কিন্তু গড্ডালিকায় ভেসে যাচ্ছে সে নান্দনিক সৃষ্টিগুলো। প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের নাটক নির্মিত হচ্ছে দর্শকদের জন্য। অথচ সেই দর্শক নাটক দেখছে না অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের কারণে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উচিত কম বাজেটে নাটকের সংখ্যা না বাড়িয়ে বরং ভালো কাজের সংখ্যা বাড়ানো। অভিনয়ে যেভাবে... আমার জন্ম ভারতের মুর্শিবাদে। বাবা রেলওয়ে চাকরি করতেন। সেই সুবাধে এ দেশে (বাংলাদেশে) আসা এবং আমার শৈশব) কৌশর কেটেছে চট্টগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। বাবা যথেষ্ট সংস্কৃতি মনা ছিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে 'টিপু সুলতান' নাটকে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করি। মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই টেলিভিশনে নাটক করি ১৯৬৮ সাল থেকে। প্রথম টেলিভিশন নাটক 'ইডিপাস'। এরপর অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। এখনো করছি। ক্যামেরার পেছনে... আসলে পরিচালনার আগ্রহ হারিয়ে যায় বাজেট স্বল্পতার কারণে। যে বাজেট দেওয়া হয় তাতে ইচ্ছেমতো শিল্পী, লোকেশন, প্রফস্‌ কোনো কিছুই হয় না। তার পরেও করা হয়। প্রতি বছরই দুয়েকটি নাটক পরিচালনা করা হয়। এবারও করার ইচ্ছে আছে। আশা করছি, রোজার ঈদে দর্শকরা আমার পরিচালনায় নতুন নাটক দেখতে পাবেন। নতুনদের নির্দেশনা... নতুনদের মধ্যে কয়েকটি ক্যাটাগরি আছে। এক ধরনের নতুন নির্মাতা আছেন যারা প্রচন্ড আগ্রহী, শিক্ষিত ও মেধাবী। যারা কাজ বুঝেন। তাদের সঙ্গে কাজ করে ভালো লাগে। দ্বিতীয়ত, যারা কম বুঝেন তবে আগ্রহ আছে। আরেক ধরনের আছে যারা কিছুই বুঝে না। এদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে খারাপ লাগে। হতাশ হই। তার পরেও কাজ করতে হয় প্রফেশনের জায়গা থেকে। অভিনয়ে নতুনরা... নতুনদের মধ্যে অনেকের কাজই ভালোলাগে। স্কুলিং ছাড়া যে কেউ অভিনয়ে আসতে পারে, এটা অপরাধ নয়। তবে তার মধ্যে অভিনয় শেখার ক্ষুধাটাও থাকতে হবে। আর রাতারাতি তারকা হওয়ার স্বপ্ন না বুনে, অভিনয়শিল্পী হওয়ার চেষ্টায় বিভোর থাকতে হবে। সফলতা পেতে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করতে হয়। অল্প পরিশ্রমে সফলতার স্থায়িত্ব হয় না। ক্লান্তি... আমার কোনো ক্লান্তিবোধ নেই। অভিনয়, পরিচালনা, লেখালেখি এসব নিয়েই থাকতে ভালো লাগে। অভিনয় তো আমার সঙ্গে মিশে গেছে। অভিনয় না করলে ভালো লাগে না। আলস্নাহর কাছে প্রার্থনা করি যত দিন বেঁচে থাকি ততদিন তিনি যেন আমায় অভিনয় করার শক্তি দেন।