তিন ছবিতেই সীমাবদ্ধ ভাষা আন্দোলন!

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

রায়হান রহমান
ফাগুন হাওয়ায় ছবির একটি দৃশ্য
ভাষা জয়ের ৬৮ বছরে বহু ছবি নির্মিত হয়েছে। হাতেগোনা দুয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ ছবির প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। অবাক করার বিষয় হলো, যে ভাষা ব্যবহার করে এত বছর ধরে ছবি নির্মাণ হচ্ছে, সে ভাষা রক্ষার আন্দোলন নিয়ে নেই ছবি নির্মাণ। টেলিস্কোপ দিয়ে খোঁজতে গেলে তিনটির বেশি ছবির হদিস মিলবে না। এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন গত বছরের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি মুক্তি পাওয়া তৌকীর আহমেদের 'ফাগুন হাওয়ায়'। তার আগে ২০০৬ সালে মুক্তি পায় শহীদুল আলম খোকন পরিচালতি 'বাঙলা' ছবিটি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে সর্বপ্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি 'জীবন থেকে নেয়া'। জহির রায়হান পরিচালিত এ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ছবি মুক্তির এ পরিসংখ্যান দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণ হচ্ছে না কেন? এ বিষয় চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলন নিয়ে তেমন একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। ?৫২ সালের বিষয়বস্তু ক্যামেরায় তুলে আনতে টাকার প্রয়োজন। সাধারণ ছবির তুলনায় অনেক বেশি কষ্ট করে এসব ছবি তৈরি করতে হবে। আবার প্রযোজক টাকা ফেরত পাবেন কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। তবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য অবশ্যই ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র হওয়া দরকার। এ আন্দোলনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের এক এক করে আমরা হারিয়ে ফেলছি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটুকু জানেন, সেটাও ভাবার বিষয়। চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই এ ইতিহাস সহজে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সম্ভব। কিন্তু এটাও সত্যি বাণিজ্যিকভাবে এ চলচ্চিত্র হয়তো সফল হবে না।' এদিকে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি ছবির গল্পেও ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস পরিপাটিভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে শহীদুল আলম খোকনের 'বাঙলা' চলচ্চিত্র ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি আবেগতাড়িতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে চিত্রনায়িকা শাবনূর, হুমায়ুন ফরীদি ও মাহফুজ আহমেদ অভিনয় করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র একজন বোবা স্ত্রী। কেবল ভাষার মিছিলই সেই নারীকে চঞ্চল, কৌতূহলী করে তোলে। বাংলায় চিৎকার করতে বলে। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' সেস্নাগান এক সময় সেই নারীকে স্পষ্টভাবে প্রথমবারের মতো 'বাংলা' শব্দটি উচ্চারণ করায়। তখনই তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে, সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অন্যদিকে 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিতে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, ও 'এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে' গান ব্যবহার করে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আগের সময়কার দৃশ্য দেখানো চেষ্টা করেছেন। রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেনের মতো অভিনেতারা তাদের অতিমানবীয় অভিনয়ে ছবিটিকে ইতিহাসের অংশ বানিয়েছেন। মূলত জহির রায়হানের হাত ধরেই দেশে ভাষা আন্দোলনের সিনেমার পত্তন হয়। এরপর দীর্ঘ বিরতী। সর্বশেষ গত বছর ১৫ ফেব্রম্নয়ারি মুক্তি পায় তৌকীর আহমেদ পরিচালিত 'ফাগুন হাওয়া'। ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন নুসরাত ইমরোজ তিশা ও সিয়াম আহমেদ। এ ছবিতে অভিনয়ের প্রসঙ্গে তিশা বলেন, 'ছবিতে আমি একজন মফস্বলের মেয়ে। এলাকার তরুণরা ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে একটা নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়। সেটা ধরেই এগিয়ে যায় ছবির গল্প। এই ছবির প্রতিটি সংলাপেই ছিল ভাষা আন্দোলনের ছোয়া।' একই সুরে কথা বলেন সিয়াম আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমার মনে হয়, এ সময়ের তরুণ হয়ে এ রকম একটা ইতিহাসনির্ভর চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা বা জড়িত হতে পারা আনন্দের। ফাগুন হাওয়ায়-এর চিত্রনাট্য পছন্দ করার সবচেয়ে বড় কারণ, এটা ভাষা আন্দোলনের ঘটনাকে ছুঁয়ে যাওয়া চিত্রনাট্য। এটা এমন একটা ঘটনা, যেটা আমাদের জাতীয় এবং ব্যক্তিগত জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ধরনের ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমাদের মতো শিল্পীদের একটা ক্ষুধা সব সময়ই থাকে। সেই ক্ষুধাটা আমরা মিটিয়েছি।' এদিকে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা বুলবুল বিশ্বাস বলেন, 'ইচ্ছা থাকা শর্তেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি বানাতে পারছি না। ভালো চিত্রনাট্য ও কোনো প্রযোজক যদি লগ্নি করতে প্রস্তুত থাকেন আমি ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি বানাতে চাই। ঢাকাই চলচ্চিত্রে এখনো উলেস্নখ করার মতো ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। কার্যতই সেলুলয়েডের পর্দায় আজও অধরাই রয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। বিষয়টি চলচ্চিত্রাঙ্গনের জন্য চরম ব্যর্থতার একটি অধ্যায় বলেই মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।