সংগীত ভুবনের দুই মহাতারকা

রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিন। দেশের সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বল দুই নক্ষত্র। তারা দুজনই উপমহাদেশের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী। দীর্ঘদিন একসঙ্গে, একমঞ্চে গান গাইতে গাইতে এক ধরনের বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। বাঙালি ও বাংলাদেশের গর্ব বাংলা গানের জীবন্ত এই দুই কিংবদন্তিকে গানের পাখি, সুরেলা কোকিল বলেও বিশেষত করা হয়। যুগ যুগ ধরে দেশের আপামর শ্রোতাদের বিরামহীন মুগ্ধ করে আসছেন তারা। দেশের সংগীতে অবদানের জন্য একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন সংগঠনের অসংখ্যবার সেরা গায়িকা এমনকি আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন তারা। আলোকিত নারী হিসেবেও বিবেচিত হয়েছেন বেশ কয়েকবার। আগামী ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে দেশবরেণ্য এই অনন্য দুই আলোকিত তারকাকে নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের তারার মেলার প্রধান প্রতিবেদন। লিখেছেন- জাহাঙ্গীর বিপস্নব

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিন
রুনা লায়লা 'শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো, তোমাদেরই মন ভরাবো শিল্পী হয়ে তোমাদেরই মাঝে চিরদিন আমি রবো, শিল্পী আমি শিল্পী'। গানে গানে এ কথা অনেক আগেই বলেছেন উপমহাদেশের অন্যতম গায়িকা রুনা লায়লা। এ যেন নিছক গানই নয়; কথা আর সুরের মালায় নিজের জীবনেরই সত্যি কথাগুলো এভাবেই গেঁথেছেন তিনি। পাঁচ দশক ধরে সুরের সুরভি ঢেলে দিয়ে আসছেন রুনা লায়লা। তার মোহময় সুরের ভুবনে শ্রেম্নাতারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে আজো। কিংবদন্তি এই শিল্পীর সুরের মূর্ছনা, ঝঙ্কার আর জাদুতে বন্দি হয়ে আছে কোটি কোটি শ্রোতা। তার সুর সমুদ্রে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে সব বয়সী শ্রোতারই। লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক- সব ধাঁচের গানই গেয়েছেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিসহ ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন রুনা। এ পর্যন্ত তার গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। এখনো অবিরত গেয়ে চলেছেন তিনি, দেশে- বিদেশে নিয়মিত করছেন স্টেজ শো, চলচ্চিত্রের গানে এখনো তার কণ্ঠ ধারণ করে চলেছে এই প্রজন্মের তারকারা। আগামীকাল ৮ মার্চ 'বিশ্ব নারী দিবস'। দিবসটি নিয়ে আলোকিত এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে গেলে শুরুতেই অনেকটা হতাশ হতে হলো। কারণ শুরুতেই জানালেন নারীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনকে বেছে নিয়ে 'নারী দিবস' হিসেবে মানতে নারাজ তিনি। রুনা লায়লার ভাষ্য, শুধু আমি নই, আমার মতো দিবসটি নিয়ে অনেকেরই মাথাব্যথা নেই। নারীর দিবস দিয়ে আসলে কী হয়। কী থাকে এই দিবসে। মূলত নারীকে হেয় করার জন্যই এ দিবসের উৎপত্তি বলে মনে হয় আমার কাছে। এ দিবসের মাধ্যমে নারীকে যেন নতুন করে মনে করে দেয়া হয় তিনি একজন নারী। এটা আমার কাছে ততটা গ্রহণযোগ্য না'। 'সেরা নারী ও বাংলাদেশ' শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানে কীর্তিময়ী নারী হিসেবে তিনি এ সম্মাননা পেয়েছিলেন। সংগীতে অসামান্য অবদান রাখায় রাউন্ড দ্য ক্লক ও বাংলানিউজের যৌথ আয়োজনে রুনা লায়লাকে এ সম্মাননা দেয়া হয়। আয়োজনে রুনা লায়লাকে উত্তরীয়, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র দেয়া হয়। এ ছাড়াও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ে গতবার হ্যাটট্রিক করলেন রুনা লায়লা। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া 'প্রিয়া তুমি সুখী হও' ছবিতে মনমাতানো গায়কির জন্য টানা তৃতীয়বার এ স্বীকৃতি পান তিনি। এর আগে ২০১২ সালে 'তুমি আসবে বলে' আর ২০১৩ সালে 'দেবদাস' ছবির গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান রুনা। এ ছাড়া স্বাধীনতা পদক (১৯৭৭), বাচসাস পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, ভারতের সায়গল পুরস্কার, পাকিস্তানের নিগার অ্যাওয়ার্ড, ক্রিটিক্স পুরস্কার, গ্র্যাজুয়েট পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। আর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ক্ষেত্রে হ্যাটট্রিককেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। সম্প্রতি চিত্রনায়ক আলমগীর পরিচালিত 'একটি সিনেমার গল্প' ছবিতে প্রথমবার সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেই সেরা সুরকার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। শিল্পী হিসেবে পুরস্কার পারওয়ার চেয়ে এই পুরস্কার যেন তার সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাত্র সাড়ে ১২ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি ছবি 'জুগনু'র মাধ্যমে গানে অভিষেক হয় রুনা লায়লার। ওই ছবির 'গুড়িয়াসি মুন্নি মেরি' তার জীবনের প্রথম গাওয়া গান। বাংলাদেশের ছবিতে রুনা লায়লার গাওয়া প্রথম গান হলো গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ও সুবল দাসের সুরে 'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে'। লাহোরে থাকাকালেই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে দেশে স্থায়ীভাবে চলে আসার পর প্রথম তিনি গেয়েছেন সত্য সাহার সুরে 'জীবন সাথী' ছবিতে। তার সহশিল্পী ছিলেন খন্দকার ফারুক আহমেদ। বলিউডের বেশ কয়েকটি ছবিতে গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। সর্বশেষ গেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত 'অগ্নিপথ' ছবির 'আলীবাবা মিল গ্যায়া চলিস্নশ চোর সে' গানটি। বলিউডে তার গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'ও মেরা বাবু চেইল চেবিলা'। এর সংগীত পরিচালনা করেন এম আশরাফ। পাকিস্তানের 'মান কি জিত' (১৯৭২) ছবির এ গানটি ব্যবহার হয় বলিউডের 'ঘর দুয়ার' (১৯৮৫) ছবিতে। পাকিস্তানে তার গান 'দমাদম মাস্ত কালান্দার' ভীষণ জনপ্রিয়। গানের বাইরে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'শিল্পী' ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন রুনা লায়লা। এখানে তার সহশিল্পী ছিলেন আলমগীর। পরবর্তী সময়ে তাকেই বিয়ে করেন রুনা। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে রুনা লায়লার জন্ম। তার বাবা মোহাম্মদ ইমদাদ আলীর বাড়ি রাজশাহীতে। সাবিনা ইয়াসমিন জীবন্ত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের ভুবনে আধিপত্য বজায় রেখেছেন। মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে এখনকার শিল্পীদের সঙ্গে অবিরাম গেয়ে চলেছেন। উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার আর. ডি. বর্মণের সুরে গান গাওয়া, বিখ্যাত সংগীতশিল্পী কিশোর কুমারের ও মান্না দে'র সঙ্গেও ডুয়েট গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা। বাংলা গানের অসম্ভব জনপ্রিয় শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় চার দশক ধরে সংগীতের ভুবনে তার সগর্বে বিচরণ। উচ্চাঙ্গ ধ্রম্নপদ লোকসংগীত থেকে আধুনিক বাংলা গানসহ চলচ্চিত্র মিশ্র আঙ্গিকের সুর- যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই যেন সোনা ফলেছে। শুধু দেশের গানেই তার যে অবদান, তা দিয়েই তিনি এ বাংলার বুকে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। বছরজুড়ে বিভিন্ন সময় তার গাওয়া দেশের গান আমাদের পুলকিত করে, অনুপ্রাণিত করে, আন্দোলিত করে। আর দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তার গাওয়া দেশের গানই যেন আগামী দিনে নতুন করে পথচলার সাহস জোগায়। দেশের গান ছাড়াও চলচ্চিত্রে হাজার হাজার গান গেয়েছেন তিনি। আর এমনি করেই গানে গানে সাবিনা ইয়াসমিন হয়ে উঠেছেন এ দেশের তথা বাংলা ভাষাভাষীর অতি প্রিয় একজন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজারের মতো গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। ১২ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও আরও নানান সম্মাননা। \হছোটবেলায়ে খুবই চঞ্চল প্রকৃতির ছিলেন এ শিল্পী। মা ও বোনদের গানের মধ্য দিয়েই তার গাওয়া শুরু। প্রথমে 'খেলাঘর' নামে বেতার অনুষ্ঠানে ছোটদের গান করতেন সাবিনা ইয়াসমিন। বেতার ও চলচ্চিত্রে বড়দের গান করেন ১৯৬৭ সালে। বড়দের গানে যাত্রা শুরু হয় স্কুলে পড়ার সময়েই। তাই তৎকালীন দ্বৈত গানে পেস্নব্যাক করতে অনেক সময় দুই বা তিন ধাপের টুল ব্যবহার করতে হতো তাকে। এখনকার গান করতে আগের মতো পরিশ্রম, সময় বা ধৈর্যের ঘাটতি আছে বলে মনে করেন সাবিনা ইয়াসমিন। আগের দিনের গানগুলোর মতো এখনকার চলচ্চিত্রের গান তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে শিল্পীদের গানের সঠিক রয়ালিটি না থাকাটা একটা অতৃপ্তি হিসেবে দেখেন তিনি। গান নিয়ে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, গান আমার রক্ত, শিরা-উপশিরা। গান আমার নিঃশ্বাস, বেঁচে থাকার খোরাক। যতদিন দেহে প্রাণ থাকবে, ততদিনই আমার কণ্ঠে গান থাকবে। সারাজীবন এমনকি মৃতু্যর পরও ভক্ত-শ্রোতাদের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।'