পানসে হয়ে গেছে নাটকের সংলাপ

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২০, ০০:০০

মাসুদুর রহমান
'খুব জানতে ইচ্ছে করে' নাটকে জাহিদ হাসান ও তারিন
'মেয়ে দেখলে ঘুরতে ইচ্ছে করে পিছ পিছ। ফেসবুকে মানুষকে ডিস্টার্ব করছ, মেয়ে দেখলে লোল পড়ে, অঁ্যা! অসভ্য।' সম্প্রতি প্রচারিত 'থাপ্পরে লেগে থাকা প্রেম' নাটকের একটি সংলাপ। এখনকার নাটকগুলোতে এভাবেই ব্যবহার হচ্ছে অমার্জিত-অসার ও অরুচিকর সংলাপ। বলা হয়, সংলাপ নাটকের প্রাণ। নাটকে চরিত্রগুলো মুখর হয় সংলাপের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এখনকার নাটকে তা নেই। এক সময় টিভি নাটক থেকে শুধু বিনোদনই নয়, মানুষ শিখেছেও অনেক কিছু। বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার ক্ষেত্রে নাটক এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে। শিল্পীদের চমৎকার সংলাপে মুগ্ধ হতেন দর্শক। সাহিত্যের রস, নতুনত্ব ও শ্রম্নতি মধুর ছিল নাটকের সংলাপ। শহর বন্দর, গ্রামসহ সব শ্রেণির দর্শকের কাছে এসব নাটক সমাদৃত ছিল। দর্শকরা সেইসব নাটকের সংলাপ আওড়াতেন। সংলাপের কারণে অভিনয়শিল্পীরা পরিচিতি পেতেন। শ্রম্নতিমধুর সংলাপ নাটকের মান বাড়িয়ে দিত বহুগুণ। কিন্তু আজকাল তার বিপরীতমুখী আমাদের নাটকের সংলাপ। আকর্ষণীয় সংলাপের পরিবর্তে এখন নাটকে চলিত ও আঞ্চলিক ভাষার ছড়াছড়ি। আকর্ষণীয় সংলাপের পরিবর্তে চলছে সাদামাটা সংলাপ। অশুদ্ধ ভাষার পাশাপাশি নাটকে চলছে কুরুচিপূর্ণ সংলাপ। কোনো কোনো নাটকে অশ্লীল সংলাপ ঢাকতে ভিপ ব্যবহার হলেও কখনো কখনো ভিপও ব্যবহার হয় না। গত ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে একটি নাটকে নায়িকার সংলাপ ছিল এমন- 'ওই শালার বেটারে দেখছিস, শালার বেটারে দেখলেই আমার মাথা গরম অইয়্যা যায়। রাস্তাঘাটে তো ফলো করতাছেই, ফেসবুকেও এখন গুঁতাগুঁতি শুরু করছে।' এ সংলাপের চেয়েও কুরুচি সংলাপ ব্যবহৃত হচ্ছে নাটকে। সুমিত রায় অন্তর নামে একজন নাট্য পরিচালক তার ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, 'একটি নাটকের সংলাপ ছিল এমন- 'শালীর ঘরে শালী, একদম নড়বি না মাইরা ফেলব... শালীর ঘরে শালী'। অন্তরের কথায় বাংলা টিভি নাটকে এমন সংলাপ! কীভাবে সম্ভব? টিভির প্রিভিউ কমিটি থাকে, তারা দেখল না? তারা কীভাবে ছাড় দিল এ সংলাপকে? এরপর আরেকটি সংলাপ- 'কুত্তার বাচ্চা, চারটা বছর তুই আমাকে ইউজ করছো, তারপর ছুড়ে ফেলে দিছো,' 'ধরাধরি করতে ভালো লাগতেছে? চল উপরে চল, ধরাধরি করি।' অন্তর বলেন, টিভি নাটক হলো ড্রয়িং রুম মিডিয়া। একটি পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে টিভি দেখে। সেখানে এ ধরনের গালিগালাজ, অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ সংলাপ আসলেই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বাচ্চারা এ নাটক দেখে কী শিখবে। তাহলে কি অবক্ষয় এবার বড় পর্দা ছাড়িয়ে ছোট পর্দায় এসে ভর করেছে? নাটকের এ পরিস্থিতির জন্য নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, টিভি কর্তৃপক্ষ সবাই দায়ী। নাট্য নির্মাতা হিসেবে আমি বড়ই লজ্জিত।' নাটকে আঞ্চলিকতা ও ভাষা বিকৃতি নিয়ে অনেক শিল্পীও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেক শিল্পী মনে করেন, যদি আঞ্চলিক কোনো নাটক হয় সেটা ভিন্ন কথা। বিনা কারণে টিভি নাটকে বাংলা ভাষার উচ্চারণে অশুদ্ধতা, অসংলগ্নতা সমর্থন যোগ্য নয়। আমাদের দ্রম্নত ভাষা বিকৃতির এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত। তা না হলে এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ওপার বাংলার টিভি সিরিয়ালগুলোতে দেখা যায় শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার। আমাদের দেশের দর্শকরাও সেসব নাটক দেখছেন নিয়মিত দেশীয় সিরিয়াল উপেক্ষা করে। এ সময়ে আমাদের প্রায় ২৩টি টিভি চ্যানেলে প্রতিদিন একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রচার হয়। এসব ধারাবাহিকের দুই-চারটি ছাড়া অন্যগুলোর দিকে দর্শকের তেমন আগ্রহ নেই। এসব নাটকে অহরহ দেখা যায় আঞ্চলিক ভাষা ও পানসে সংলাপ। এ নিয়ে ড. ইনামুল হক বলেন, 'নাটকের ভাষা কিংবা সংলাপ নিয়ে বলতে বলতে যেন শেষ হয়ে গেলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পরিবর্তন হচ্ছে না। মিডিয়া হচ্ছে গুরুত্বপূণ একটি মাধ্যম। এর মধ্যে নাটক অন্যতম। আজকাল নাটকে ভাষার বিকৃতি চরমে পৌঁছেছে। শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই। যে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া হয়েছে সেই ভাষার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ভাষার অবমাননা করা হচ্ছে। নাটকে ভাষা কিংবা সংলাপের মান বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব। এ জন্য অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সবারই দায়িত্ব রয়েছে। এব্যাপারে চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।' অভিনেতা ও নির্মাতা আবুল হায়াত বলেন, 'এটি আমদের জন্য দুঃখজনক বিষয়। নাটকের সংলাপ আগের মতো জোড়ালো হচ্ছে না। একটা সময় আমাদের নাটকের সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে শোনা যেত। আর এখন নাটক দেখার পর দর্শক কি দেখেছে সেটিই ভালোভাবে বলতে পারে না। ক্রমেই নাটকের সংলাপগুলো খুব দুর্বল হয়ে পড়ছে। কখনো কখনো কুরুচি সংলাপও ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের নবীন নির্মাতাদের অনেকের মধ্যেই আঞ্চলিক ভাষায় নাটক নির্মাণ যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। এটি থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারছে না। আজকাল তারা নাটক নির্মাণে ক্ষেত্রে আগে ভাষা নির্বাচন করে। কোন অঞ্চলের ভাষা দিয়ে নাটক নির্মাণ করবে সেটির দিকে তাদের গুরুত্ব থাকে বেশি।'