আমিও এক সময় সুপারস্টার ছিলাম

দেশীয় চলচ্চিত্রে নব্বইয়ের দশকের শক্তিশালী অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তার অভিনয় শুরু ১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তিনি তিনশ’র অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে তার অভিনীত বহুল আলোচিত ও ব্যবসাসফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। সমাজসেবামূলক অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দ্বিতীয় সবোর্চ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভ‚ষিত করেছেন। সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। লিখেছেন আকাশ নিবির

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ইলিয়াস কাঞ্চন
বতর্মান ব্যস্ততা কী নিয়ে? এখন সেভাবে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত নই। তবুও এ বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বিজলী’ ছবিতে চিত্রনায়িকা ববির অনুরোধে অভিনয় করেছি। আগে যৌথ রবিঠাকুরের কবিতা অবলম্বনে প্রযোজনায় নিমির্ত ‘হঠাৎ দেখা’ ছবিতে অভিনয় করছি। এই ছবিতে আমার বিপরীতে অভিনয় করেছেন কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। সম্প্রতি আমি আর চম্পা বাংলাভিশনে প্রচারের জন্য নিমির্ত ধারাবাহিক নাটক ‘সোনালি দিন’-এ অভিনয় করছি। মাতিয়া বানু শুকুর রচনায় নাটকটি পরিচালনা করেছেন রোকেয়া প্রাচী। এরই মধ্যে নাটকটির ৫২ পবের্র শুটিং শেষ হয়েছে। এ ছাড়াও ‘বাংলার ফাটাকেস্ট’ নামক একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। সেটি এ বছর মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পেছনের গল্পটা কী ছিল? আমার প্রথম স্ত্রী জাহানারার মৃত্যুতে আমি মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কোনো ছবিতে অভিনয় করব না। সেই সময়ে পাশে এসে দঁাড়ান একজন সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেনÑ দেখ কাঞ্চন, স্ত্রীকে বঁাচাতে না পারায় তুমি খুবই ভেঙে পড়েছ। তাই হয়তো তুমি এমন চিন্তা করছ। কিন্তু এটি তো কোনো সমাধান হতে পারে না। হাজার হাজার ভক্ত তোমাকে ভালোবাসে। তাদের মধ্যে অনেকেও সড়ক দুঘর্টনায় মারা যায়। যদি পার তাদের জন্য কিছু কর। তখন মনে হলো, ছেলেমানুষি করে নিজের জীবিকার উৎস থেকে সরে দঁাড়ানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাতে কেবল নিজেকেই কষ্ট দেওয়া হবে। একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম সড়ক দুঘর্টনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার। নাম দিলাম ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)। চলচ্চিত্রের ব্যস্ততার পাশাপাশি সদ্য মাতৃহারা ছোট্ট ছেলেমেয়েদের দেখভালের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর। তখন অনেক শুভাকাক্সক্ষীই আমাকে বলেছিলেন, কী দরকার এসব করার! যেভাবে সবকিছু চলছে, সেভাবেই চলুক না! কাঞ্চনকেই কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হবে! কিন্তু এসব কথায় কান দিইনি। আলিঙ্গন করে নিয়েছি চ্যালেঞ্জকে। মনে জেদ চেপে গেল। জীবনের সব চেয়ে স্মরণীয় দিন কোনটি? মনে আছে, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রথম কমর্সূচির জন্য ডিসেম্বর মাসকে বেছে নিয়েছিলাম। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর এফডিসি থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পযর্ন্ত পদযাত্রা বের করি। সেই পদযাত্রায় প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। তবে অধিকাংশ মানুষই যতটা না এসেছিলেন নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে, তার চেয়েও বেশি আমাকে ভালোবেসে। এরপর থেকে যখনই কোনো কমর্সূচির আয়োজন করেছি, সাধারণ মানুষের অফুরান ভালোবাসা পেয়েছিলাম। সেদিনই ছিল আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে কতটা সফল হয়েছেন বলে মনে করেন? ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করতে এসে আমার চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার প্রায় নষ্টই হয়েছে। আমি অবশ্য ওই সময় ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবিনি। এই আন্দোলন যখন শুরু করলাম, প্রথম দিকে কোনো সাফল্য পাইনি। বরং অনেকে আমাদের গালাগালি করতেন। কেউ বলতেন, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন সবাই বোঝে, দুঘর্টনা কারও না কারও গাফিলতির জন্য, অনিয়মের জন্য ঘটছে। এটা শুধু নিয়তির বিষয় না। আমরা এই সচেতনতাকে আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সফলতা মনে করি। অভিনয় জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি কী? এক সময় আমিও চলচ্চিত্রের সুপারস্টার ছিলাম (হাসি)। সব সিনেমাপ্রেমী ভক্তরা এখনও যে পরিমাণ ভালোবাসে এর চেয়ে আর কি প্রাপ্তি থাকতে পারে। তবে আমি যখন অভিনয়ে অভিজ্ঞ হয়েছি, ঠিক সে সময়ে অভিনয় থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। এটাকেই আমার অপ্রাপ্তি মনে হয়। বতর্মানে চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? এখন মূলত একজন শিল্পীকে বেইজ করেই ছবি হচ্ছে। আমি যখন সুপারস্টার ছিলাম, তখন এ দেশে বছরে ১১০ থেকে ১২০টা ছবি রিলিজ হতো। এখন হয় ৪০ থেকে ৪৫টা ছবি। তখন সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৪০০। এখন বড়জোর ৩০০ থেকে ৩২০টি আছে। সিনেমা হলগুলো ভেঙে এখন মাকের্ট হচ্ছে! তাছাড়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন যেখানে অবস্থান করছে, এমন সময়ে অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। তবে আমার বিশ্বাস এবং মনে প্রাণে প্রত্যাশা করি, চলচ্চিত্রের সংকট কেটে যাবে। এফডিসি নিয়ে স্মৃতি? দীঘর্ ৪০ বছর কাটিয়েছি এফডিসিতে। এখানকার প্রতিটি ইট, বালুতে আমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একসময় এই এফডিসির প্রতিটি ফ্লোরে, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে আমার অবাধ বিচরণ ছিল। ক’দিন আগে একটি নাটকের শুটিংয়ের কাজে গিয়েছিলাম এফডিসিতে। আসলে এফডিসি গেলে এখন খুব নস্টালজিয়ায় ভুগি। আবারও সুদিন আসবে। এই দেশের চলচ্চিত্রে অনেক গুণী মানুষ রয়েছেন। তাদের সংস্পশের্ আসার সুযোগ পেলে আমাদের একটা মজবুত প্রজন্ম গড়ে উঠবে বলে বিশ্বাস আমার। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলুন ... আমার কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। মানুষের সব আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করার মতো পরিস্থিতি যদি কখনো পাই, তা কাজে লাগাব। নিজের জন্য কিছু করার দরকার নেই। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াও নেই। আমি বেঁচে থাকার জন্য দুটি খেতে পারলেই হলো। তবে এটা আমি জোর গলায় বলব। আমাদের বাংলাদেশের সব মানুষ নিরাপদে বঁাচতে হলে অবশ্যই নিরাপদ সড়ক চাই। আর অভিনয় করতে করতেই চলে যেতে চাই।