বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায় ৩২টি বই সাজিয়ে যে মেলা শুরু করেছিলেন ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী)-এর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা- তা আজ বাংলা একাডেমি পেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে বিস্তৃত। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পাওয়া বাংলা ভাষা আজ আমাদের রাষ্ট্রভাষা। শুরু হতে যাচ্ছে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা', আজ স্বারম্ভরে পর্দা উঠবে। বাংলা একাডেমি থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে এ মেলা। এ মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য, আবেগ-আকাঙ্ক্ষা, অহংকার, ত্যাগ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বন্ধন। বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমিকে সরাসরি মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে কাজী মুহম্মদ মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' আয়োজন সম্পন্ন করেন। লেখক-পাঠক-প্রকাশকসহ সব বইপ্রেমীর মহামিলনের মাস বলে খ্যাত ফেব্রম্নয়ারি মাস। এ বইমেলা হৃদবন্ধনের মেলা, জাতীয় চেতনার মেলা, ঐতিহ্যের মেলা এক কথায় এ যে আমাদের শুদ্ধপ্রাণের আলো জ্বালানো এক প্রাণের মেলা। এ মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য, আবেগ-আকাঙ্ক্ষা, অহংকার, ত্যাগ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভালোবাসার প্রতীক।
তৎকালীন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আমাদের বাংলা ভাষাকে কলুষিত করে আমাদের চির দাসত্বের জালে আটকে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু ওরা বীর বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। রক্তে রঞ্জিত হয়ে বাংলা ভাষা, মায়ের ভাষা বিশ্ব দরবারে আজ মাথা উঁচু করে সম্মানে দাঁড়িয়েছে। লেখক-পাঠক-প্রকাশকসহ সব বইপ্রেমীর মহামিলনের চেতনার মাস ফেব্রম্নয়ারি। হৃদবন্ধনের মেলা, জাতীয় চেতনার মেলা, ঐতিহ্যের মেলা এ বইমেলা। এক কথায় এ মেলায় বই ও মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি জ্ঞানচর্চার পেছনে অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রভাব সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। বলতে গেলে, প্রায় সবাই বইমেলার সময়ে তাদের বইগুলো প্রকাশ করেন। বাকি অন্য ১১ মাসে কয়টা প্রকাশিত হয় তা হাতে গুনে বের করা যায়। সবারই আগ্রহ থাকে ফেব্রম্নয়ারিতেই বই প্রকাশ করবেন। বইমেলার শুরুর কিছুদিন আগেই প্রকাশনা ও ছাপাখানাগুলোতে মন দিয়ে ভুল সংশোধন খুট খুট শব্দ নিয়ে খুশির আমেজ বিরাজ করে। এ সময় তাদের নেই কোনো অবকাশ, দিনরাত পরিশ্রম করে চলছেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাংলার মননে এই মেলার প্রভাব ও অবদান অনেক গুরুত্ব বহন করে চলছে।
ফেব্রম্নয়ারি মাস অন্য মাসের চেয়ে একটু ভিন্নভাবেই আমাদের হৃদয় মনকে আন্দোলিত করে। তবে, পরিতাপের বিষয় যে, ফেব্রম্নয়ারি মাস শুরু হলেই বাংলা ভাষা নিয়ে সর্বত্র একটা হইচই শুরু হয়। কিন্তু এ হইচই বছরজুড়েই হওয়া উচিত। বই, শুধু বই নিয়ে সবাই মেতে উঠবে। প্রিয় লেখক ও প্রিয় বই নিয়ে পাঠকদের আগ্রহের কোনো কমতি থাকে না। মননশীল, সৃজনশীল মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকবে পুরো মেলাঙ্গনজুড়ে। দেখা হবে, কথা হবে, আবার আড্ডাও হবে দূর-দূরান্তের কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকারসহ প্রথিতযশা মানুষের সঙ্গে। অটোগ্রাফ দেয়া-নেয়া, জাতীয় নজরুল মঞ্চে প্রতিদিনই নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে মাসজুড়ে। শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন একে অন্যের সঙ্গে। বই হোক হৃদয়ের খোরাক, ভালোবাসার প্রতীক। আলোকিত মানুষ হয়ে সমাজের ক্লেশ দূর করতে প্রেরণা জোগায় বই। শুদ্ধপ্রাণের এ বইমেলায় সবাইকে আহ্বান জানাই, হানাহানি বন্ধ করে হৃদয়ে শুভবুদ্ধির চর্চা করুন। শুদ্ধপ্রাণের আলো জ্বেলে আমরাও হব আলোকিত। জয়তু একুশে গ্রন্থমেলা, জয়তু শুদ্ধপ্রাণের মিলনমেলা।
সাংবাদিক ও সংগঠক