শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রবিধানমালা

করোনায় ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৮ এপ্রিল ২০২১, ২১:০৮

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে হৃদরোগীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ হার্ট অ্যাটাকসহ, স্ট্রোক ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তাই কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ শীর্ষক খসড়া প্রবিধানমালা সর্বসাধারণের মতামতের জন্য ওয়েবসাইট http://www.bfsa.gov.bd -এ আপলোড করেছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ সব ব্যবসায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ ভোক্তাসাধারণকে কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের

http://www.bfsa.gov.bd/sites/default/files/files/bfsa.portal.gov.bd/law/54c31e4f_08a6_4e15_ad6d_0842bdf10f26/2021-03-25-14-56 0bb49602743eb0962b87d64294f7e91.pdf লিঙ্কে গিয়ে ‘ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’- এর প্রণীত খসড়ার ওপর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা [email protected] অথবা [email protected] বরাবর মতামত প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

কর্তৃপক্ষের সূত্রমতে, আগামী ৫ মে ২০২১ পর্যন্ত এসব মতামত গ্রহণ করা হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সকল তেল, চর্বি এবং খাদ্যে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাটের সীমা বেঁধে দিয়ে তা সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রান্সফ্যাটি এসিড রেগুলেশন কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ যায়যায়দিনেক বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ ২ শতাংশের মধ্যে কমিয়ে আনার জন্য সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আমরা এই লক্ষ্য সামনে রেখে খসড়া প্রবিধানমালাটি প্রণয়ন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের খাদ্যদ্রব্যে যাতে ট্রান্সফ্যাটি এসিড ২ শতাংশের নিচে থাকে সেটা নিশ্চিতে কার্যক্রম চলছে। তবে বিধিমালা বা আইন থাকলে ট্যান্সফ্যাটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যার মূল উদ্দেশ্য দেশের জনগণের সুস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেওয়া। আশা করি আগামী দুই থেকে চার মাসের মধ্যে আমরা বিধিমালাটি প্রকাশ করতে পারব। তখন ব্যবসায়ীদের একটা সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এরপর কেউই খাদ্যদ্রব্যে ২ শতাংশের বেশি ট্যান্সফ্যাট ব্যবহার করতে পারবে না। করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’-এ বলা হয়েছে রুমিন্যান্ট বা প্রাণিজ উৎসজাত টিএফএ বাদে চর্বির ইমালসনসহ যেকোনো তেল ও চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যেকোনো খাদ্যের উদ্দেশ্যে অথবা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যেকোনো খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) অথবা যেকোনো খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রামের অধিক টিএফএ থাকলে তা বিক্রয়, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানি করা যাবে না। এছাড়া মোড়কজাত খাদ্যের লেবেলে অবশ্যই ট্রান্সফ্যাটি এসিড ও পিএইচও সম্পর্কিত তথ্য ঘোষণা করতে হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও, যা বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামেই সুপরিচিত। সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে পিএইচও বা ডালডা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

এদিকে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও বা ডালডা ব্র্যান্ডসমূহের মোট ২৪টি নমুনা বিশ্লেষণ করে পরিচালিত সম্প্রতি এক গবেষণার ফলাফল বলেছে ৯২ শতাংশ নমুনায় ডব্লি¬উএইচও সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্সফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। এমনকি প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যা ডব্লি¬উএইচওর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রান্সফ্যাটি এসিড (টিএফএ) বা ট্রান্সফ্যাট মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি ক্ষতিকর এবং অপ্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। ট্রান্সফ্যাট এমন এক ধরনের ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় খাদ্য উপাদান, যা রক্তের এলডিএল বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বৃদ্ধি করে, অপরদিকে এইচডিএল বা ‘ভালো কোলেস্টেরল’ এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে চলমান কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা আরও বলছেন, ২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে বছরে অন্তত ৫ হাজার ৭৭৬ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে ৪৮০ জন। তাই যতই বিলম্বিত হচ্ছে ট্রান্সফ্যাটের নিয়ন্ত্রণ, ততই বেড়ে যাচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত অথচ প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু সংখ্যা।

জানতে চাইলে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এর কার্ডিওভাস্কুলার হেলথ-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিডার মুহাম্মাদ রুহুল কুদ্দুস যায়যায়দিনকে বলেন, নিঃসন্দেহ ট্রান্সাফ্যাট মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এটি শরীরের আর্টারিগুলোকে চিকন করে দেয়। ফলে মানুষ হার্ট ডিজিজের শিকার হয়ে থাকে। ফলে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি অর্থাৎ সকল ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা, অথবা পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল-পিএইচওর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

তাই বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাটি এসিডের অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই), ন্যাশনাল হার্ট ফউন্ডেশন, প্রজ্ঞা (প্রজ্ঞতির জন্য জ্ঞান) এবং কনিজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কাজ করছে। শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে এই চার প্রতিষ্ঠানের অ্যাডভোকেসির ফলে বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ একটি খসড়া প্রবিধানমালা তৈরি করছে। গত মাসের ২৪ তারিখে তারা তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। নোটিশ বোর্ডে দিয়েছে। সম্ভবত চলতি মাসের ২৫ তারিখের মধ্যেই তারা বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তিকে তাদের মতামত দিতে বলছে। মতামতগুলো বিচার-বিবেচনা করার পর তারা এটিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে এবং মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এখন বাংলাদেশ নিরাপদ কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের চাওয়া, তারা যেন আগামী জুনের মধ্যে প্রবিধাণমালাটা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করে।

খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রণীত খসড়া প্রবিধানমালাকে অবিলম্বে চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়ে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)-এর নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘ট্রান্সফ্যাটমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা যাবে না কোনো অজুহাতে। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল হলে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু থেকে অনেকাংশে রেহাই পাবে এদেশের সকল স্তরের মানুষ।’ এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত বৃদ্ধির মাধ্যমে ট্রান্সফ্যাটমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে Heart Health Alert BD < https://www.facebook.com/hearthealthalertbd/ > শীর্ষক সুসংগঠিত একটি ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করছে সংগঠনটি। ক্যাম্পেইনটির দাবি ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করি, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাই’।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে