করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারের ঝুঁকি হ্রাসে নাগরিকদের মাস্ক ব্যবহারে সরকার কতজনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছে, গত একবছরে সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে। সংক্রমণ রোধে অনত্যম সুরক্ষা সরঞ্জাম ‘মাস্ক’ ছাড়াই সাধারণ মানুষ অবাধ চলাফেরা করছেন। অনেকে আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবদ এড়াতে শাড়ি বা ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকছেন। রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এমন উদাসীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার রাজধানীর মোহাম্মাদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মিরপুর-১, পল্লবী, ইসিবি চত্বর, ও মিরপুর-১৪ সহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই নারী-পুরুষ উভয়কে অবাধে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আগ্রহ দেখা যায়নি বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে। সামাজিক দুরত্ব বজায় না রেখেই উদাসীনভাবে চলাফেরা করতে গেছে অনেককে। মাস্কবিহীন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষের সঙ্গে আলাপে বিচিত্র কিছু অভিব্যক্তি পাওয়া গেছে।
কেউ শাড়ি ও ওড়নাকে মাস্কের বিকল্প মনে করছেন, কেউ ভ্যানিটি ব্যাগে মাস্ক রেখে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কারও মাস্ক থুতনীতে, কারও আবার কানে ঝুলিয়ে রাখতে দেখা গেছে। সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও মাস্ক না পরার কারণে রাস্তা-ঘাটে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জেরা কিংবা জরিমানার মুখোমুখি হয়েছেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে তিনি এমন কাউকে খুঁজে পাননি।
সোমবার মিরপুরের ইসিবি চত্বরে কথা হয় সফুরা বেগম নামে এক মধ্যবয়স্ক নারীর সঙ্গে। রাজধানীর মানিকদি এলাকার এই বাসিন্দা বেশ কয়েকটি বাসাবাড়িতে ঝি এর কাজ করেন। মাস্ক না পরে বাইরে কেনো বের হয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘মহিলাদের আবার মাস্ক লাগে নাকি! শাড়ি ও ওড়নাতো আমাদের মাস্ক। পুলিশ দেখলে শাড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি, চলতে সমস্যা হয় না। পুলিশ ধরেই নেন, নারীদের জন্য বিকল্প মাস্ক শাড়ি ও ওড়না।’
গাবিনা ইয়াসমিন নামে আরেকজনকে মাস্ক না পরেই ঘুরতে দেখা যায় মিরপুরের সাগুফতা এলাকায়। তার মাস্ক পরিধান না করা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করতেই পেশায় গৃহিণী ওই নারী জানান, মাস্ক পরলে তার দম বন্ধভাব মনে হয়। তাই বাইরে বেড় হলে পুলিশের ভয়ে একটা মাস্ক হাতের ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিয়েছেন।
বাউনিয়াবাঁধ এলাকার তরমুজ ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম প্রতিদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়িসহ সব পাইকারি বাজারে নির্ধিদ্বায় ঘুরে বেড়ান। তিনিও মুখেও মাস্ক পরেন না। কারণ জানতে চাইলে বলেন, মাস্ক পরলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাই পকেটে থাকে বের করা হয়ে ওঠে না। ফার্মগেট, আগারগাঁও ও শ্যামলী এলাকায় ভ্যানে ফেরি করে ডাব বিক্রির জন্য ঘুরে বেড়ান মোবারক নামের আরেক ব্যক্তি। জীর্ণ একটা মাস্ক থুতনির নিচে রেখে তাকে ক্রেতার জন্য ডাব কাটতে দেখা যায়। জানতে চাইলে বলেন, পুলিশ দেখলে পরি। এখন পর্যন্ত জরিমানা গুণতে হয়নি। শুধু সফুরা বেগম, সাগুফতা বা সিরাজুল ইসলাম-ই নয় তাদের মত অনেকে মাস্ক না পরার ঝুঁকি সম্পর্কে জানলেও কোনভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা (ইউএনসি) হেলথ কেয়ারের এক গবষেণায় বলছে, কেবল একসঙ্গে দুটি মাস্ক পরলে তা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে।
জানতে চাইলে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট শ্যামলী টিবি হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রামিত ভাইরাস। যা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে কেউ মাস্ক পরিধান না করে বাইওে বেড় হলে যে কোন মহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রত্যকের সুরক্ষিত মাস্ক না থাকলেও অন্তত ওয়ানটাইম বা কাপড়ের মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হওয়া উচিত।
নারীদের শাড়ি বা ওড়না মাস্কের বিকল্প হতে পারে কিনা জানতে চাইলে এই বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ বলেন, পরিহিত শাড়ি বা ওড়না মাস্কের বিকল্প হতে পারেনা। তাছাড়া সব সময় এভাবে সব সময় মুখ ঢেকে চলাফেরাও সম্ভব না। শাড়ি বা ওড়নাকে মাস্ক মনে করা অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর চিন্তা। যেখানে চিকিৎসা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ডাবল মাস্ক তথা দুই স্তরের মাস্ক পরার কথা, সেখানে শাড়ি ও ওড়নার দিয়ে মুখ ঢেকে চলা অজ্ঞতার পরিচয়। কারণ এগুলো কোনভাবেই ভাইরাস রোধে সুরক্ষা দিতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের আধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, করোনার মত মরণব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য সামান্য মাস্ক পরার দায়িত্বটুকু নিতে পারছে না অনেকে, এটা নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা। অথচ হাসপাতালের কোভিড আক্রান্তদরকে বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্য কর্মীরা দিনের দীর্ঘসময় সঙ্গে পিপিই ও এন-৯৫ এর মত শক্ত মাস্ক পরে থাকেন। পানি পর্যন্ত পান করতে পারে না দীর্ঘসময়। তিনি বলেন, এই মাস্ক না পরা দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষগুলো নিজেদের স্বজনদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। এমনটা চলতে থাকলে কোনভাবেই মহামারী মোকাবিলা সম্ভব হবে না।
যাযাদি/ এস