করোনা পরিস্থিতিতে দিশেহারা পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দেশে করোনায় শনাক্ত ও মৃতু্য এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সঙ্গত কারণেই এই পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপ কমাতে ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের সময়সীমা ১৪ দিন বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ে শিল্প-কারখানাও বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরেও শনাক্ত ও মৃতু্য কমছে না। কঠোর লকডাউনের চতুর্থদিনে সর্বোচ্চ ২৪৭ জনের মৃতু্য হয়েছে। একদিনে আক্রান্ত হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকট চলছে। চলছে অক্সিজেন সংকট। এর ফলে সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, রাজধানীর ১৯ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। সাধারণ শয্যাও প্রায় শেষ। গত সাত দিনে করোনায় গড়ে শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৮ হাজার মানুষ। এদের ৭৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে। এর বড় অংশই উন্নত চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসছেন। ফলে শয্যা সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এদের মধ্যে মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বাঁচাতে স্বজনরা ছুটছেন আইসিইউর সন্ধানে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল, মুগদা মেডিকেল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালসহ ১৯টি থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরছেন তারা। সরকারি পরিসংখ্যান মতেই ৩৫ জেলায় আইসিইউ সুবিধা পাচ্ছেন না রোগীরা। সারাদেশের মোট আইসিইউ শয্যার ৭৬ শতাংশই ঢাকা বিভাগের হাসপাতালগুলোতে। এর মধ্যে রাজধানীতেই ৭৩ শতাংশ। করোনা সংক্রমণ শুরুর পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট চালুর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। দুঃখ সে নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের বিভাগীয় পর্যায়ে অথবা রাজধানীতে ছুটতে হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। তারা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বহুজন পথেই মারা যাচ্ছেন। দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ১০০টি হাসপাতালের মধ্যে ৫২টিতেই আইসিইউ সুবিধা নেই। এর মধ্যে ৩৫টি হাসপাতালই জেলা সদর হাসপাতাল। মোট আইসিইউর প্রায় ৭৫ শতাংশই ঢাকা বিভাগে, ২৫ শতাংশ বাকি সাত বিভাগে। জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা থাকলে মৃতু্য কমানো সম্ভব হতো বলে মনে করেন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা। করোনা পরিস্থিতিতে যেমন বিপর্যস্ত বিশ্ব। তেমনি দেশেও করোনার বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা করলে করোনা সংক্রমণের বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশ এমন কথা বারবার উচ্চারিত হলেও সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে উদাসীন। জেল জরিমানা করেও তেমন সুফল আসছে না। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় ১৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ১১ লাখের বেশি মানুষ। দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকট তীব্র। ফলে মৃতু্যর হার বেশি। এটা সত্য, করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়িয়ে দীর্ঘায়িত করা হলেও এর কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অধরাই রয়ে গেছে। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসহ ৪৩টি জেলায় করোনা সংক্রমণ তীব্র। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চিকিৎসার জন্য মানুষ রাজধানী ঢাকায় ছুটে আসছে। অথচ ঢাকার হাসপাতালগুলোতে শয্যা খালি নেই। রয়েছে আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকট। দেশে নতুন শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই গ্রামে বসবাসরত জনগণ। এসব রোগী রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরেও শয্যা পাচ্ছেন না। পথে অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর মৃতু্য হচ্ছে। স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হচ্ছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচকে বর্তমানে এশিয়ায় পঞ্চম অবস্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ। এই মুহূর্তে দেশের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের লাগাম টানতে চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃতু্যতে নতুন রেকর্ড হয়েছে। এ সময় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ ২৩২ জনের মৃতু্য। সংক্রমণ চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছর মার্চে ভাইরাসটির প্রকোপ শুরুর পর একদিনে এর চেয়ে বেশি রোগী আর কখনও শনাক্ত হয়নি। এত মৃতু্যও দেখতে হয়নি দেশের মানুষকে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচকে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২২তম এবং এশিয়ায় পঞ্চম। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে হলে জনসাধারণকে দুটি নিয়ম মেনে চলতে হবে। প্রথমত, সঠিক নিয়মে মাস্ক পরতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয়ত, সব ধরনের জনসমাগম পরিহার করতে হবে। দেশের করোনা পরিস্থিতি খারাপ হলে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ রোগী বাড়লে অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। তাই সরকারকে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে অক্সিজেনের ঘাটতি না পড়ে। অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের জিম্মি করে অক্সিজেনের দাম বেশি রাখছে। এ ব্যাপারে সরকারের তদারকি থাকতে হবে। করোনাকালে মানুষকে জিম্মি করা অমানবিক। আমাদের দেশের বড় সমস্যা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ সচেতন নয়, তারা মাস্ক পরতে চায় না, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তো বালাই নেই। এখন যে কঠোর লকডাউন চলছে এবং বিনা কারণে মানুষ ঘরের বাইরে আসায় তাদের জরিমানা ও আটক করা হচ্ছে। তাতেও মানুষ ভয় পাচ্ছে না। গলিতে গলিতে চলছে আড্ডা, অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। আশার কথা, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপ প্রতিরোধে করোনার টিকা দেশে এসেছে। এর মধ্যদিয়ে করোনা মহামারির ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যে টিকা নিয়ে চলমান সংকট আপাতত কাটতে শুরু করেছে। করোনার টিকাসংক্রান্ত উদ্বেগ নিরসন হোক এবং টিকা সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিতরণে সমন্বয় করে টিকা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন হোক। দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অন্তত ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দেওয়া জরুরি। যে করেই হোক টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে হবে। ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রায় ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর তীব্রতা এতই বেড়েছে, উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বল্পতম সময়ের মধ্যে রোগীদের মৃতু্য হচ্ছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পাঁচ দিনের মধ্যে ৫২ শতাংশ করোনা রোগীর মৃতু্য হচ্ছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ রোগী উপসর্গ শুরু পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভর্তি হয়েছিল। ১২ শতাংশ ভর্তি হয় উপসর্গ শুরু ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে। এমন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। মাঝে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে গিয়েছিল। তখন দিনে ৫ থেকে ৬০০ জন আক্রান্ত হতো। মৃতু্য নেমে এসেছিল ১০-এর নিচে। তখন সবার মাঝে ঢিলেঢালাভাব লক্ষ্য করা গেছে। তখনো বাংলাদেশ ছাড়া সারাবিশ্বে টালমাটাল অবস্থা, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থাও আশংকাজনক পর্যায়ে ছিল। এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে আমরা উদাসীন হয়ে পড়লাম। যার চরম খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতি ৭ মিনিটে একজন রোগীর মৃতু্য হচ্ছে। দেশ থেকে করোনার প্রকোপ ও মৃতু্য কমে আসুক, দেশের মানুষ নিরাপদে থাকুক এ প্রত্যাশাই করছি। সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক।