তবুও সফলতা নিয়ে সংশয়

অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের তালিকা নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হ আগেও অভিযান চালানো হলে তা ব্যর্থ হয়েছে হ প্রভাবশালী মালিকরা পাত্তা দেন না প্রশাসনকে হ লাইসেন্স পেতে মানতে হয় অনেক কঠিন শর্ত

প্রকাশ | ৩০ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ মে ২০২২, ০৯:১৭

সাখাওয়াত হোসেন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন এবং যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে দেশের ১১ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। ৯ হাজার ২৪টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে কোনো কোনোটি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলেও এখনো অনুমোদন পায়নি। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক বেসরকারি ক্লিনিকের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেই অর্থে সেগুলোও অবৈধ। তবে লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হিসাব থাকলেও অনুমোদন না পাওয়া এবং আবেদন না করেই চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নাম ও অবস্থান জানে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখন তৈরি করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এ অবস্থায় নিবন্ধনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধে প্রসাশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাঁড়াশি অভিযানে নামলেও তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, এর আগেও বিভিন্ন সময় অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে কোনো অভিযানই বেশিদিন চলমান থাকেনি। লোক দেখানো অভিযানে কিছু অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সামান্য ক'দিন বন্ধ থাকলেও প্রভাবশালী মালিকরা তা ফের চালু করেন। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ অবস্থায় করোনাকালে রিজেন্ট ও জিকেজি হাসপাতালের কেলেঙ্কারির পর সমালোচনার মুখে পড়ে স্বাস্থ্য বিভাগ। তবুও এ বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ততটা গায়ে মাখেনি। গত ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে হাসপাতাল কর্মীদের মারধরে মৃতু্য হয় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুল করিমের। এরপর আবারও স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; শুরু হয় সমালোচনা। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল অনুমোদনহীন হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। অনুমোদনহীন হাসপাতালের অনিয়মের ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী। এর আগে ৮ নভেম্বর বিভাগীয় পরিচালকদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তিন কার্যদিবসের মধ্যে নিজ নিজ জেলার অনিবন্ধিত, অবৈধ, নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালিত ও সেবার মান খারাপ এমন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে বলেও জানানো হয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর সিভিল সার্জনরা নিজ নিজ এলাকার অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তালিকা অধিদপ্তরে পাঠিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও বাস্তবে এর সত্যতা মেলেনি। যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার তৎকালীন পরিচালক ডা. ফরিদ হোসেন মিয়ার বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে। ওই সময় তিনি জানান, অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা জানা গেলেও সব প্রতিষ্ঠানের নাম ও অবস্থান জানা যায়নি। সব অবৈধ প্রতিষ্ঠান দ্রম্নত বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে তিনি দাবি করলেও দেড় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও তার কিঞ্চিত বাস্তবায়ন হয়নি। প্রশাসনিক সূত্র জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমার পর ২০২০ সালে সরকার এ খাতে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নেয়। লাইসেন্স নবায়ন বা আবেদন করতে এ বছরের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে জমা পড়ে ১৪ হাজারের মতো আবেদন। কথা ছিল যারা আবেদন করবে না, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কিন্তু তা খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। আবার যেসব আবেদন জমা পড়েছে, তাদের মধ্যে হালনাগাদ লাইসেন্স ছিল ৫ হাজার ৫১৯টির। অসম্পূর্ণ আবেদনপত্র ছিল তিন হাজার ৩০৪টি। এগুলোর কোনোটির ট্রেড লাইসেন্স নেই; কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আবার কোনোটির রয়েছে অনান্য ত্রম্নটি। ফলে আইন অনুযায়ী এদেরও নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগ আছে, হাসপাতালের লাইসেন্সের বিষয়টি দেখভাল করার কথা টাস্কফোর্স কমিটির। কিন্তু দীর্ঘদিন এই কমিটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে লাইসেন্স প্রাপ্ত মোট ৬ হাজার ৬৭টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতাল ২ হাজার ১৩০, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৩ হাজার ৮৫৬ ও বস্নাড ব্যাংক ৮১টি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন সময় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা প্রভাবশালী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তারা পাত্তা দেয় না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের সখ্য থাকে। অনেক সময় প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করেই তারা তাদের রমরমা বাণিজ্য করেন। এ ছাড়া এত হাসপাতাল পরিদর্শনের মতো জনবলও নেই অধিদপ্তরের। একজন পরিচালক, দুজন উপপরিচালক, তিনজন সহকারী পরিচালক ও পাঁচজন মেডিকেল অফিসারের পক্ষে হাজার হাজার হাসপাতাল দেখভাল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে স্বাস্থ্য খাতে এ ধরনের অনিয়মের পেছনে সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর নাসরিন সুলতানা। তিনি বলেন, সরকারের যে জনবল কম তা সবাই জানে। কিন্তু সীমিত জনবল দিয়েই যাতে কাজটা সঠিকভাবে করা যায় সেই ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি না করলে, হাসপাতালগুলো থেকে অনিয়ম দূর হবে না। উলেস্নখ্য, ১৯৮২ সালের মেডিকেল অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। অথচ ঢাকা বিভাগেই অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৩৫টি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ২৩২টি, খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৫২৩টি, রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৪৩৮টি, রংপুর বিভাগে ১ হাজার ৯৯টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯৬৩টি, বরিশাল বিভাগে ৬০৩টি এবং সিলেট বিভাগে ৫৪৬টি অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০১৮ সালে লাইসেন্স নেওয়া ও নবায়নের জন্য অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতি চালু হয়। তাতে কোনো একটি শর্ত পূরণ না হলে রেজিস্ট্রেশন হয় না, নবায়নও হয় না। অনেকে ঠিকমতো শর্ত পূরণ করতে না পেরে আবেদন করছে না বলেও জানা গেছে। আর অবৈধ হাসপাতাল ক্লিনিক বলতে অধিদপ্তর তাদেরই ধরছে যারা অনলাইনে আবেদন করেনি। এদিকে, হাসপাতাল মালিকরা বলছেন, লাইসেন্স করা ও নবায়নের নতুন নিয়মে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। শর্তগুলোও কঠিন। ২০১৭ সালের আগে ক্লিনিকের নবায়নের জন্য শুধু ফি জমা দিতে হতো পাঁচ হাজার টাকা, সঙ্গে ভ্যাট। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি এবং নবায়ন ফি পাঁচ হাজার থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া বিভাগীয় ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০ থেকে ৫০ শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নবায়ন ফি ৫০ হাজার টাকা, ৫১ থেকে ১০০ শয্যার জন্য এক লাখ টাকা, ১০০ থেকে ১৪৯ শয্যার জন্য দেড় লাখ টাকা ও ২৫০ শয্যার জন্য নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ টাকা। একইভাবে একই শয্যা সংখ্যা ধরে জেলা হাসপাতালগুলোর জন্য ধরা হয় ৪০ হাজার টাকা, ৭৫ হাজার টাকা ও এক লাখ টাকা। উপজেলা পর্যায়ে এ ফি নির্ধারণ করা হয় ২৫ হাজার, ৫০ হাজার, ৭৫ হাজার ও এক লাখ টাকা। একই সঙ্গে এসব হাসপাতালে কমপক্ষে তিনজন এমবিবিএস চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও দুইজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার শর্তও আছে। প্রতিটি শয্যার জন্য থাকতে হবে ৮০ বর্গফুট জায়গা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রোপচার কক্ষ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং নারকোটিকসের লাইসেন্সও থাকতে হবে। এর সঙ্গে আরও দরকার হবে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) ও বিআইএন (বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর)। শয্যা বেশি হলে আনুপাতিক হারে জনবলও থাকতে হবে। পরে আবেদনের ভিত্তিতে অধিদপ্তরের টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে লাইসেন্স দেয়। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিকদের অভিযোগ, এসব কঠিন শর্তের কারণে ইচ্ছে থাকলেও তারা লাইসেন্স নিতে পারছেন না। অথচ অনুমোদিত অনেক প্রতিষ্ঠান বেশকিছু শর্ত পূরণ না করেই নির্বিঘ্নে চলছে। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিরা তাদের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। লাইসেন্সের শর্ত সহজ হলে সবাই অনুমোদন নিয়েই ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালাবে বলে মনে করেন তারা।