অচেনা উপসর্গে বাড়ছে মৃত্যু 

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৯ | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৩১

সাখাওয়াত হোসেন

মাদারীপুরের কালকিনির মুদি দোকানি শহর আলী এক সপ্তাহ আগে জ্বরে আক্রান্ত হন। এ সময় তার শরীরের তাপমাত্রা ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ডেঙ্গু জ্বরের নিয়মিত কোনো উপসর্গ না থাকায় এটিকে মৌসুমি জ্বর ধরে নিয়ে চিকিৎসার ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব দেননি তিনি। তবে তিন দিন আগে আকস্মিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসেন। মহানগরীর একটি হাসপাতালে প্রথম দিন সাধারণ শয্যায় এবং পরের দু’দিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। 
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত ডেঙ্গুতে অনেক বেশি জ্বর থাকে। তবে এবারের ডেঙ্গুতে অনেকের শরীরের তাপমাত্রা ১০১-১০২ ডিগ্রির বেশি উঠছে না। হেমোরেজিকের পরিবর্তে শকড সিনড্রোম বেশি হচ্ছে। আগে ডেঙ্গুতে হাড় বা শরীরের সংযোগস্থলে মারাত্মক ব্যথাও হলেও এবার বেশিরভাগ রোগীর শরীরে এসব উপসর্গ অনুপস্থিত। তাই অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারছে না। অথচ দ্রুত সময়ের মধ্যে অনেকের অবস্থা জটিল হয়ে উঠছে। সাধারণত ডেঙ্গুতে এমন লক্ষণ দেখা যায় না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী জানান, এবার শকড সিনড্রোম বেশি হচ্ছে। এর আগে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বেশি দেখা গেছে। শকড সিনড্রোমে শরীরে পানি কমে যায়, তাপ বেড়ে যায়, হার্টবিট কমে যায়, ব্লাডপ্রেশার কমে যায় এবং রোগী জ্ঞান হারাতে পারে। ফুসফুস ও পেটে পানি জমে। আর হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ হয়, শরীরে র‌্যাশ ওঠে, তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৫ হয়। এটার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। তাই সে বুঝতে পারে কী করতে হবে।

অথচ এবারের ডেঙ্গুতে তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি থাকছে, র‌্যাশ দেখা যায় না, রক্তক্ষরণও হয় না। ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না যে, তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ফলে চিকিৎসার ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। জ্বর চলে যাওয়ার পরে প্লাটিলেট ভেঙে ব্লাডপ্রেশার কমে কলাপস করে। ফলে এবার মৃত্যুর হার বেশি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুসরাত সুলতানা বলেন, পরীক্ষা না করে নিশ্চিত করে বলা যায় না রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কি-না। অনেকে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে দেরি করছেন। এ কারণে চিকিৎসা করতেও দেরি হচ্ছে। অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর ভালো হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এ ভালো হয়তো অনেক খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসতে দেরি হচ্ছে। হাসপাতালে জটিল অবস্থায় আসার কারণে তাদের আইসিইউ’র প্রয়োজন হচ্ছে। সংকট থাকায় সব রোগীকে দ্রুত আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। সাধারণত ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে নেওয়ার ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মারা যান। তবে এবার এর চেয়ে অনেক কম সময়ের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে একই সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের দু’টি ধরন সক্রিয় আছে। এর জন্য রোগীর জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকতে পারে। রোগীর শরীরে তরল ব্যবস্থাপনা (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) এবং অণুচক্রিকা ব্যবস্থাপনা ঠিক হচ্ছে কি-না, তার সঠিক চিত্র জানা নেই।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এনএস-১ পরীক্ষা করলে পজিটিভ হতে পারে। পাঁচ-ছয় দিন পর পরীক্ষা করলে নেগেটিভ আসে। সপ্তম দিনে আইজিএম পরীক্ষা করলে পজিটিভ রিপোর্ট আসবে। এর দুই দিন পর পরীক্ষা করলে নেগেটিভ আসবে। তখন আইজিপি পরীক্ষা করতে হবে। এভাবে রোগীকে ধাপে ধাপে পরীক্ষা করে দেখতে হবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কি-না। একই সঙ্গে প্লাটিলেট কাউন্ট পরীক্ষা করতে হবে। নিজেরা কোনো একটি পরীক্ষা করে নেগেটিভ রিপোর্ট পেয়ে বসে থাকলে হবে না। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে পরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে খামখেয়ালি করলে বিপদ, মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। অনেক সময় ডাক্তাররাও খামখেয়ালিপনা করেন। তবে এটা ঠিক নয়। রোগীর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জেনে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন। ৮১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে। এর অর্থ যারা মারা যাচ্ছেন, তারা দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। যখন হাসপাতালে আসছেন তখন চিকিৎসকদের বিশেষ কিছু করার থাকছে না।
ওই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, মৃত রোগীর ৬৪ শতাংশের মধ্যে ডেঙ্গুর শকড সিনড্রোম দেখা গেছে। ২৪ শতাংশ রোগীর লক্ষণ ছিল এক্সপানডেড ডেঙ্গু। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ছিল ৮ শতাংশ রোগীর। আর মৃত ব্যক্তির ৪ শতাংশের অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের সঙ্গে ডেঙ্গু ছিল।

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেকের জ্বর থাকছে না। কারও লক্ষণ শুধু পেটে ব্যথা, বমি কিংবা ডায়রিয়া। রক্তচাপও কমে যায় দ্রুত। লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়া রোগীদের চিকিৎসা দেরিতে শুরু হওয়ায় জটিলতা বাড়ছে। আর মারা যাওয়া রোগীদের বড় অংশ একাধিকবার আক্রান্ত।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, অচেনা উপসর্গের কারণে রোগীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এতে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। এক সময় ডেঙ্গুকে বলা হতো হাড়-ভাঙা জ্বর। কিন্তু এখন শুধু জ্বর নয়, ১৬টি লক্ষণের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে ডেঙ্গু। এর মধ্যে জ্বর, বমি, ডায়রিয়া, পেটে ও বুকে পানি জমার লক্ষণ বেশি। এছাড়া মাথা ও গলাসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা, ফুসকুড়ি, মাড়ি থেকে রক্তপাত ও হঠাৎ প্রেসার কমে যাচ্ছে অনেক রোগীর। অতিরিক্ত দুর্বলতা, চোখে ব্যথা, খিচুনি, নিউমোনিয়াও দেখা যাচ্ছে অনেকের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার রোখসানা দিল আফরোজ বলেন, লক্ষণ বদলে যাওয়ায় ডেঙ্গু যে হয়েছে সেটি বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে যেতে দেরি করছেন রোগীরা। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়ায় রোগী দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে, অনেকেই মারা যাচ্ছেন।

মেডিসিন বিভাগ সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার অপর্ণা দাশ জানান, এবার চিকিৎসা করতেও অনেক সমস্যা হচ্ছে। রোগ নির্ণয় করতেই অনেক সময় দিতে হচ্ছে। অনেকটা করোনার সঙ্গে অনেকে গুলিয়ে ফেলছেন। যার ফলে সবাই আতঙ্কিত হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ জানান, চলতি বছর এমন সব লক্ষণ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, যা ডেঙ্গুর প্রথাগত উপসর্গ নয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের এসব উপসর্গ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরে দৃশ্যমান উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগেই অনেক ডেঙ্গু রোগী শরীরের অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতায় পড়ছে।

 ডেঙ্গুর উপসর্গ হিসেবে এতদিন জেনে আসা উপসর্গগুলো ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরও রোগীটির চিকিৎসাসেবা শুরু করার পর্যায় ও ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন অনেক চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসির এক কর্মকর্তা বলেন, এবারের ডেঙ্গু যে নতুন পরিবর্তিত রূপ দেখা দিয়েছে সেটা গত বছর থেকেই টের পাওয়া গেছে। সে অনুসারে পুরনো গাইডলাইন আপডেটের কাজ শুরু করা হয়। তা ওয়েবসাইট, ই-মেইলের মাধ্যমে ঢাকাসহ বড় বড় সব জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেটা ফলো করার জন্যও বলা হয়। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে। 

ডেঙ্গু চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, সচরাচর টানা পাঁচ-ছয় দিন জ্বর থাকে। কিন্তু এবার অপেক্ষাকৃত কম সময় ধরে জ্বরের পরই হঠাৎ ক্রিটিক্যাল ফেজে মোড় নিচ্ছে। র‌্যাশ বা গায়ে ব্যথার পরিবর্তে কাশি, পাতলা পায়খানা, বমির মতো নতুন ধরনের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। দ্রুত এসজিপিটি ও ক্রিয়েটিনিন বাড়ছে, কারও কারও লাইপেজ বাড়ছে। মাল্টি অর্গান ফেইলিউর বা বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত হানা (যেমন কিডনি ফেইলিউর, যকৃতের সমস্যা, মায়োকার্ডাইটিস), বুক ও পেটে পানি জমার মতো জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অনেকের ডেঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও রক্তে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন নেগেটিভ পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফী আহমেদ বলেন, এবারের উপসর্গগুলো অচেনা। তাই অভিভাবকরা বুঝে ওঠার আগেই অনেক সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, শিশুদের অচেনা উপসর্গ দেখা দিলেও ডেঙ্গুর নানা ধরনের টেস্ট করতে হবে। যেমন- এসজিপিটি, এসজিওটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে থাকতে হবে। 

যাযাদি/ এস