তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। সরকার পতনের পর সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও অস্থিরতা শুরু হয়। যেই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য খাতে অস্থিরতা কাটিয়ে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সেখানে দলীয় রাজনীতি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এবং বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই আমলেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ ছিল। প্রায় দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। স্বাস্থ্য খাতের শীর্ষ পদে যারা নিয়োগ পেয়েছে তারা সবাই আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক। এর আগে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপিপন্থি চিকিৎসক নিয়োগ পেয়েছেন। এর বাইরে দুই দলের সরকারের আমলেই দল নিরপেক্ষ চিকিৎসকেরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ছাড়া সব সংগঠন বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ হাসপাতালে যারা রাজনীতি করে তাদের কখনও চিকিৎসায় মনোযোগ থাকে না। হাসপাতালে রোগীদের প্রাধান্য দিয়ে দেশ থেকে লেজুরভিত্তিক সংগঠন বাদ দিয়ে এগুতে হবে। তাহলে দেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর থকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অস্থিরতা চলছে। গত রোবাবার উপাচার্যসহ শীর্ষ ছয় কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। তবু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গত ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত পরপর নিয়োগ পাওয়া পাঁচ উপাচার্যরা সবাই স্বাচিপের সদস্য বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এছাড়া সহ-উপাচার্য, প্রক্টর বা অন্যরাও স্বাচিপের সদস্য বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের তিন দিন পর ৮ আগস্ট এক দিনে বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য পদত্যাগের আগে বিএনপির শাসনামলে (২০০৩-০৬ সালে) নিয়োগ পাওয়া ১৭৩ জন চিকিৎসকের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই ১৭৩ জন ছাড়াও ভিন্ন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আরও শিক্ষকের পদোন্নতি আটকে ছিল। এখন গোপনে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি প্রমোশন বঞ্চিত চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এদিকে গত রোববার উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হকসহ শীর্ষ ছয় কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। তারপর বিশ^বিদ্যালয়ের ৮ চিকিৎসকে প্রশাসনের দায়িত্বে দেওয়া হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্ব পেয়েও অস্থিরতা কাটাতে পারেননি তারা। কাজে যোগ দেননি বেশির ভাগ চিকিৎসক। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার পর সবকিছু স্বাভাবিক হলেও অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিতরা তাদের জমানো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করে। এই ক্ষোভ তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের আমল থেকে জমতে থাকে।
সাধারণ চিকিৎসকরা বলেন, চিকিৎসা একটি মহান পেশা। এখানে রাজনীতি থাকতে পারে না। রাজনীতি করতে হলে চাকরি ছেড়ে রাজনীতি করুন। দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবায় সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বিএসএমএমইউ। এটি চিকিৎসকদের জন্য একটি পবিত্র জায়গা। চিকিৎসা সেবা মহান পেশা। এ প্রতিষ্ঠানে কোনো নোংরামি চলবে না। একে সম্মান করতে হবে। কারো ক্ষতি হবে, সেটাও করা যাবে না। এখন যে পরিস্থির সৃষ্টি হয়েছে, এতে এই প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি হবে।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতকে জনবান্ধব করতে হলে দল মত নির্বিশেষে চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। এখানে দলবাজি করা যাবে না। এখন স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দপ্তর থেকে সবাইকে পদত্যাগ করলেই, যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল তা না। এখন আরও চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো। কারণ যারা নতুন দায়িত্বে আসবে বা আসছেন তাদের সঠিক পথে থাকতে হবে। আগের চলমান কাজগুলোকে প্রাধান্য নিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্টোশালাইজড হাসপাতালে চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এখন আরও চ্যালেঞ্জ বেশি। যারা নতুন দায়িত্বে আসবে বা আসছেন তাদের সঠিক পথে থাকতে হবে। নতুন কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। যারা পরবর্তীতে আসবে তারা যেন অনুসরণ করতে পারবে। রোগীর সেবায় মনোযোগী হতে হবে। রোগীদের ভোগান্তি লাগব হয় এমন সব পলিসি তৈরি করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে আরও চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে উপাচার্য করা হয়েছিল আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের। এই দলবাজি শুধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৬৪ জেলার সিভিল সার্জনের প্রায় ৫০ জন স্বাচিপের সদস্য অথবা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। এছাড়া দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে ৪৯৫টি। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়, যার দলীয় আনুগত্য আছে। কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় ব্যক্তি বসে আছেন।
এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয়। এর আগে ডা. রোবেদ আমিন অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত রোবেদ আমিন কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। ড্যাবের নেতা-কর্মীরা অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তারা চাইছেন বঞ্চিত কাউকে মহাপরিচালকের পদে বসাতে। এতে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের ক্ষোভ ও হতাশার চিত্রটি স্পষ্ট বোঝা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, যোগ্য ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় দিতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য খাত ঠিকভাবে চালানো যাবে না। তাই কে যোগ্য তাকে খোঁজে রেব করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ। কোনো দলের চাপে কাউকে পরিবর্তন করে অন্য অযোগ্য কাউকে বড় পদে বসানো উচিত না।
যাযাদি/ এসএম