মান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট

প্রকাশ | ০৮ মে ২০২৫, ১৫:৪০ | আপডেট: ০৮ মে ২০২৫, ১৬:১৮

মান্দা (নওগাঁ) প্রতিনিধি
নওগাঁর মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ছবি: যায়যায়দিন

নওগাঁর মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চরম জনবল সংকট চলছে। এতে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ আছে ২৪টি। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসক আছেন মাত্র চারজন।

প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাবে জেলার সবচেয়ে জনবহুল এই উপজেলার রোগীরা কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে সচল দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক না থাকায় এক বছরের বেশি সময় ধরে অ্যাম্বুলেন্স দুটি ব্যবহার হচ্ছে না।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, এখানে চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ রয়েছে ২৪টি। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন চারজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তাঁদের একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও)। চিকিৎসকের ২৪টি শূন্য পদের মধ্যে ১০টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। এ ছাড়া শূন্য রয়েছে ১০ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদ।

এ অবস্থায় চিকিৎসাসেবা চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে উপজেলার বিভিন্ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সাতজন স্বাস্থ্য সহকারীকে প্রেষণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পদায়ন করা হয়েছে।

চিকিৎসক সংকটে ছোট ছোট সমস্যাতেও রোগীদের রেফার্ড করা হচ্ছে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল কিংবা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। এদিকে হাসপাতালটিতে সচল দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালকের অভাবে সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডাঃ তাসনিম হোসাইন আরিফ বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় আগে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একমাত্র অ্যাম্বুলেন্স চালক অবসরে যান। এরপর থেকেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকা সচল দুটি অ্যাম্বুলেন্সই ব্যবহার হচ্ছে না।

এছাড়া অ্যাম্বুলেন্স চালানোর জন্য তেলের যে বরাদ্দ সেটিও দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অ্যাম্বুলেন্সগুলো গ্যারেজেই অব্যবহৃত অবস্থায় দিনের পর দিন পড়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্সের চালক নিয়োগ ও তেলের বরাদ্দ দেওয়ার জন্য উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হয়নি।’

নওগাঁর সবচেয়ে বড় উপজেলা মান্দা। ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই উপজেলায় লোকসংখ্যা ৫ লাখের ওপরে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০ জন রোগী বহির্বিভাগে টিকিট কাটে। এ ছাড়া জরুরি ও অন্তর্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নেয় আরও ১৩০ থেকে ১৪০ জন রোগী।

সরেজমিনে দেখা যায়, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ২০-২২ জন রোগী টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। টিকিট না কেটে চিকিৎসকের খোঁজখবর নিচ্ছে আরও অনেকে। বহির্বিভাগের দুটি কক্ষে রোগী দেখছেন দুইজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স রাখার গ্যারেজে বাইরে থেকে তালা দেওয়া। এছাড়া হাসপাতাল চত্বরে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে দুটি অ্যাম্বুলেন্স।

সেবা নিতে আসা উপজেলার বিজয়পুর গ্রামের মমতাজ বিবি ও রূপালী বেগম, ছোটবেলালদহ গ্রামের ইসাহাক আলী মোল্লা, বড়পই গ্রামের সাথী আক্তারসহ সাত-আটজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, হাসপাতালে আর আগের মতো চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না।

ঘণ্টার ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে সেবা না নিয়েই অনেক সময় ফিরে যেতে হয়। তাঁদের অভিযোগ, তা ছাড়া এখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের (প্রেসক্রিপশন) বেশির ভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়।

উপজেলার কশব ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী শামীম হোসেন বলেন, ‘বুকের ব্যথার চিকিৎসা নিতে আমি ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে হাসপাতালে এসেছি।

কিন্তু এখানে টিকিট কেটে একজন ডাক্তারকে দেখানোর পর তিনি কোনো চিকিৎসা না দিয়ে হার্টের বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তারকে দেখাতে বললেন। ভালো ডাক্তার না থাকায় এখন আমাকে রাজশাহী কিংবা নওগাঁতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।’

এলাকার বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সেবা না মেলায় উপজেলার মানুষ অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে।

কিংবা জটিল রোগীরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) ও নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় রোগীদের রাজশাহী কিংবা নওগাঁতে আসা-যাওয়া করতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে।

উপজেলার সতীহাট এলাকার বাসিন্দা সেতু বলেন, ‘সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু না থাকায় রোগীদের বাড়তি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স মান্দা থেকে রাজশাহী কিংবা নওগাঁয় যেতে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হতো।

সেখানে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হচ্ছে।  চালকের অভাবে লাখ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্স অব্যাহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা খুবই হতাশাজনক। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অবহেলার কারণে এটা হচ্ছে।’  

এ প্রসঙ্গে মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহা. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ হাসপাতালে মাত্র চারজন চিকিৎসক আছেন।

এদের দিয়ে কোনোভাবে জরুরি ও অন্ত:বিভাগের কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরও সংকট রয়েছে। এসব কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।  

জনবল চেয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই এ সমস্যার উত্তোরন হবে।’

এ ব্যাপারে নওগাঁর ডেপুটি সিভিল সার্জন মুনীর আলী আকন্দ বলেন, শুধু মান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়, জেলার অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও চিকিৎসক-সংকট রয়েছে।

বিষয়গুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্সের চালক নিয়োগের দেওয়ার জন্য উধ্বর্তন কর্তপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।