মহাকাশে সামুদ্রিক প্রাণী পাঠিয়ে কী জানা যাবে?

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০২১, ২১:৩৪

যাযাদি ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা একশরও বেশি বেবি স্কুইড এবং পাঁচ হাজারের মতো একটি আণুবীক্ষণিক প্রাণী আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পাঠাতে যাচ্ছে।

 

স্পেস এক্সের ফ্যালকন নাইন রকেটে করে ১০ই জুন, বৃহস্পতিবার আরো কিছু যন্ত্রপাতির সঙ্গে তাদের মহাকাশে পাঠানো হবে।

 

নাসার বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, মহাকাশ অভিযানের সময় নভোচারীদের দেহে কী ধরনের প্রভাব পড়ে- এই পরীক্ষার মাধ্যমে সেটা জানা সম্ভব হবে। তারা বলছেন, জীবাণুর সঙ্গে প্রাণীর সম্পর্ক বুঝতেও এই গবেষণা সাহায্য করবে।

 

নাসা বলছে, দীর্ঘ মেয়াদী অভিযানের সময় নভোচারীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এই গবেষণা থেকে এবিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পেরে।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাকাশে অভিযানের সময় নভোচারীদের দেহে যে ধরনের পরিবর্তন ঘটে সেটা দীর্ঘ দিনের উদ্বেগের বিষয়। তারা বলছেন, একজন নভোচারী ছয় মাস মহাকাশে থাকলে তার শরীরে যতো পেশি আছে তার ৪০ শতাংশই ক্ষয় হয়ে যায়।

 

নাসার একজন বিজ্ঞানী জেমি ফস্টার, যিনি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, তিনি বলছেন, মানুষ ও পশুপাখির পরিপাকতন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা বিভিন্ন অণুজীবের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মহাকাশে যাওয়ার পর মানবদেহে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে সেবিষয়ে আমাদের পুরো ধারণা নেই। মহাকাশে সামুদ্রিক প্রাণী স্কুইড পাঠানোর এই মিশন থেকে সেবিষয়ে জানা যাবে।

 

উদ্দেশ্য কী

 

নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বিবিসিকে বলেছেন, মহাকাশে মানুষের যাওয়া বা সেখানে থাকার ব্যাপারে এই গবেষণা সাহায্য করবে।

 

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শুনি যে মানুষকে চাঁদে পাঠানো হবে, মঙ্গলে পাঠানো হবে। কিন্তু মানুষের যে শরীর ও মন সেটা মহাকাশে থাকার মতো নয়।’

 

‘যেখানে মাধ্যাকর্ষণ নেই সেখানে শরীরের হাড় থেকে ক্যালসিয়ামের ক্ষয় হয়। পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষের খাবার হজম করার প্রক্রিয়ায় অনেক ছোটখাটো ব্যাকটেরিয়া জীবাণু থাকে যাদের কারণে আমাদের শরীর স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। এরকম আরো অনেক কিছু ঘটে যা আমরা এখনও জানি না।’

 

তিনি বলেন, স্কুইডের হজম করার যে প্রক্রিয়া সেখানে ব্যাকটেরিয়া কী ধরনের ভূমিকা রাখছে এই মিশনে সেটা জানা যাবে।

 

মানবদেহে মহাকাশের প্রভাব

 

আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে তো বহু বছর ধরেই নভোচারীরা যাওয়া আসা করছেন। বেশ কিছুটা সময় ধরে সেখানে বসবাসও করছেন। দেখা গেছে একটা দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকার ফলে তাদের শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে।

 

অভিযান শেষ করে নভোচারীরা যখন পৃথিবীতে নেমে আসেন তখনই তাদের সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায় না। তখনই তারা হাঁটাহাঁটি করেন না। কারণ মহাকাশ থেকে নেমে আসার পর পরই পেশি ব্যবহারে তাদের কিছু সমস্যা দেখা দেয়।

 

অনেক নভোচারী তাদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তাদের পেশি ঠিক আগের মতো করে তুলতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়েছে।

 

‘চোখেরও সমস্যা হয়। চোখের জল যে প্রেশারে থাকে মহাকাশে তো সেটা থাকে না,’ বলেন মি. ঘোষ।

 

মহাকাশে কেন আলাদা

 

মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা এবং পরিপাকতন্ত্র পৃথিবীতে যেভাবে কাজ করে সেগুলো মহাকাশে ঠিক একইভাবে কাজ করে না।

 

একই মানুষের দেহ পৃথিবী ও মহাকাশে দু'রকম কেন- এই প্রশ্নের জবাবে নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলেন, চাপ এবং মাধ্যাকর্ষণের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে মানুষের শরীরে।

 

‘পৃথিবীতে যখন হাত ধুচ্ছি, কল ছেড়ে দিলে জল হাতে পড়ছে। কিন্তু মহাকাশে সেটা হবে না। আপনি যে এক ঘর থেকে হেঁটে অনায়াসে আরেক ঘরে চলে যাচ্ছেন, মহাকাশে এটা সম্ভব নয়। এমনকি আমরা বাথরুমে গিয়ে যে কাজটা করছি সেই কাজটা করাও কঠিন। ফলে মহাকাশে যাওয়ার আগে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়।’

 

কেন স্কুইড ও টারডিগ্রেড

 

পৃথিবীতে লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণী আছে। এসবের মধ্য থেকে সামুদ্রিক প্রাণী বেবি স্কুইড ও আণুবীক্ষণিক প্রাণী টারডিগ্রেডকে কেন বাছাই করা হলো মহাকাশে পাঠানোর জন্য?

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্কুইডের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার মিল রয়েছে। এছাড়াও যে পাঁচ হাজার টারডিগ্রেড পাঠানো হচ্ছে সেগুলো এতোই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা না গেলেও তারা চরম আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে অন্য যে কোনো প্রাণীর চেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে।

 

মি. ঘোষ বলেন, ‘জীববিজ্ঞানে এরকম নমুনা নিয়েই গবেষণা করা হয়। কেন কোনো একটা বিশেষ প্রাণীকে নমুনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- এই প্রাণীটির মাধ্যমেই হয়তো সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেকারণে।’

 

ফ্রুট ফ্লাই এবং ইঁদুরের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দুটো প্রাণীর ওপর অনেক বেশি পরীক্ষা হয়। ‘কারণ এদের মাধ্যমেই সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।’

 

‘আবার সেরকম নাও হতে পারে। কিন্তু কোনো একটা জায়গায় তো গবেষণাটা শুরু করতে হবে,’ বলেন তিনি।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাকাশের মতো পরিবেশে টারডিগ্রেড কীভাবে বেঁচে থাকে এবং প্রজনন ঘটায় এই পরীক্ষা থেকে সেবিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে।

 

পৃথিবীতেও কাজে লাগবে?

 

মহাকাশে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়ে এই গবেষণায় পাওয়া তথ্য কি পৃথিবীতে মানুষের স্বাস্থ্য চিকিৎসায়ও কাজে লাগতে পারে?

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু নভোচারীদের জন্য নয়, এই পৃথিবীতে মানুষের মাসকুলার ডিস্ট্রফি বা পেশি সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসাতেও এই স্কুইড মিশন থেকে পাওয়া তথ্য কাজে আসতে পারে।

 

মাসকুলার ডিস্ট্রফি এক ধরনের জেনেটিক রোগ। এর ফলে ধীরে ধীরে পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

নাসার বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলেন, "বিজ্ঞানের বেশিরভাগ গবেষণাতেই কী পাওয়া যাবে সেটা আগে থেকে জানা যায় না। এবং এভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে।"

 

‘ক্যান্সারের সেল হচ্ছে টিস্যুর একটি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। সেই টিস্যু যদি আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানেও কি ঠিক একইভাবে এর বৃদ্ধি ঘটবে? এরকম গবেষণা থেকে কী ফল পাওয়া যাবে কে জানে!’

 

‘কিন্তু কোনো বিশেষ পরিবেশে গেলে একটা অসুখ ভাল হয়ে যায় এমনও তো হতে পারে,’ বলেন নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ। সূত্র: বিবিসি বাংলা।   

 

যাযাদি/এসআই