চ্যাটজিপিটি: দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের অনুভূতি
নতুন গবেষণা
প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৫, ১৬:০৬ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৫, ১৬:১০

একটি বিষয় স্পষ্ট এআই বা চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে শুধু লেখা নয়, মানুষের মুখের ভাষা এবং অনুভূতিও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।
গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে জুম মিটিং, ক্লাসরুম বা ইউটিউব ভিডিও মনোযোগ দিয়ে শুনলে একটি বিষয় সহজেই বোঝা যায়, তা হচ্ছে অনেকের কথা বলার ধরনে একরকম মিল চলে এসেছে। এমনটি আসলে এআই, বিশেষ করে চ্যাটজিপিটির প্রভাবের ফল।
তারা বলছেন, ‘Prowess’ বা দক্ষতা ও ‘tapestry’ বা বোনা নকশার মতো কিছু শব্দ চ্যাটজিপিটি বেশি ব্যবহার করে, যা এখন মানুষের কথ্য ভাষায়ও ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে বা বেশি ব্যবহার হচ্ছে।
আবার ‘bolster’ বা সহায়তা করা, ‘unearth’ বা আবিষ্কার করা ও ‘nuance’ বা সূক্ষ্ম পার্থক্য-এর মতো কিছু শব্দ চ্যাটজিপিটি তেমন ব্যবহার করে না। ফলে এসব শব্দের ব্যবহার মানুষের মধ্যে দিনদিন কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট ভার্জ।
গবেষকরা বলছেন, চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের ফলে মানুষের কথা বলা ও যোগাযোগের ধরন বদলে যাচ্ছে। চ্যাটজিপিটি’র কারণে মানুষের ভাষা ও কথাবার্তায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে, যেটি ভবিষ্যতে আরও দ্রুত বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে।
ইউটিউবের প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজারটি শিক্ষামূলক ভিডিও বিশ্লেষণ করে ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’-এর গবেষকরা বলছেন, ‘meticulous’ বা খুব সতর্ক থাকা, ‘delve’ বা গভীরে খোঁজাখুঁজি করা, ‘realm’ বা ক্ষেত্র বা জগৎ ও ‘adept’ বা দক্ষ এ ধরনের শব্দগুলো আগের তিন বছর যেভাবে ব্যবহার করতেন তার চেয়ে এখন ৫১ শতাংশ বেশি ব্যবহার করছেন মানুষ।
গবেষকরা বলছেন, চ্যাটজিপিটি আসার আগে মানুষের ভাষায় বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি, অর্থাৎ এখানে এআইয়ের প্রভাবটাই মূল বিষয়। আর আগের গবেষণায় উঠে এসেছিল, এসব শব্দ বেশি ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি।
ওই গবেষণায় মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে লেখার ১০ হাজারটি তুলনা খতিয়ে দেখেছিলেন গবেষকরা।
এ গবেষণায় সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যারা এভাবে কথা বলছেন তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না যে, তাদের বলার ভাষা বদলে যাচ্ছে, যেটি এ গবেষণার মূল বিষয়।
গবেষকদের নজরে একটি শব্দ বিশেষভাবে ধরা পড়েছে এ গবেষণায়। বর্তমানে ‘delve’ শব্দটি ‘ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্যাম্প’ বা মানুষের ভাষার গায়ে লেগে থাকা চ্যাটজিপিটি’র ছাপ হয়ে উঠেছে।
এখন অনেক শিক্ষামূলক ভিডিও বা আলোচনা শুনলে এ শব্দটি শোনা যায়। যেমন– ‘আজকে আমরা এই বিষয়ে একটু ডেলভ করব’। যার মানে, একটু গভীরে ঢুকে দেখব। এখন শব্দটি কেবল বইপত্রে নয়, বরং মানুষের মুখের ভাষাতেও ঢুকে গিয়েছে।
আগে যেখানে ‘ভালোভাবে দেখি’ বা ‘গভীরে গিয়ে বুঝি’ বলা হত এখন হুট করেই ‘ডেলভ’ শব্দটি মানুষের মুখে এসে যাচ্ছে।
এ গবেষণার প্রধান গবেষক ও ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’-এর ড. গবেষক হিরোমু ইয়াকুরা বলছেন, ‘আমরা না বুঝেই এসব ভার্চুয়াল শব্দভাণ্ডারকে আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার ভেতরে টেনে নিচ্ছি।’
গবেষকরা বলছেন, বিষয়টি কেবল মানুষ কীভাবে এআইয়ের ভাষা ব্যবহার করছে তা নয়, বরং ধীরে ধীরে এআইয়ের মতো শোনাতে শুরু করেছেন মানুষ। এআই নিয়ে গবেষণা এখনও শব্দ বা শব্দচয়ন নিয়ে হলেও মানুষের ভাষার ধরনেও বদল আসছে।
মানুষ এখন কী বলেছেন তা নয়, বরং কীভাবে বলছেন যে বিষয়টিও বদলে যাচ্ছে। মানুষের কথা এখন আগের চেয়ে বেশি গোছানো, দীর্ঘ ও কাঠামোগত। অথচ আগে মানুষের মুখের ভাষায় আবেগ থাকত, হাসি, ক্ষোভ ও উত্তেজনা থাকত। এখন সেগুলো অনেকটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
এ গবেষণার সহলেখক ও ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’-এর গবেষক লেভিন ব্রিঙ্কম্যান বলেছেন, “ডেলভ শব্দটির ব্যবহার তো হিমশৈলের চূড়া মাত্র, এর নীচে আরও অনেক কিছু লুকিয়ে আছে।”
এআইয়ের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ‘স্মার্ট রিপ্লাই’, ‘অটোকারেক্ট’ ও ‘স্পেলচেক’-এর মতো ফিচারগুলোতে।
‘কর্নেল ইউনিভার্সিটি’র একদল গবেষক খতিয়ে দেখেছেন, মানুষ যখন চ্যাটিংয়ে ‘সাউন্ডস গুড’, ‘থ্যাংক ইউ’ ও ‘লেটস গো’-এর মতো স্মার্ট রিপ্লাই ব্যবহার করেন তখন গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ে ও ঘনিষ্ঠতার অনুভূতিও বেশি হয়।
কারণ এসব স্মার্ট রিপ্লাই বেশিরভাগ সময়ই ইতিবাচক বা ভদ্র ভাষায় লেখা থাকে, যা শুনতে বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হয় তাদের কাছে।
তবে গবেষণায় উঠে এসেছে, এমন ক্ষেত্রে একজন চ্যাটিং পার্টনার যদি মনে করেন, সামনের জন বুঝি এআই দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন তখনই বিষয়টি বদলে যায় এবং ওই সময় তিনি আরও মনে করেন, সামনের জন কম সহযোগী ও রোবটের মতো আচরণ করছেন।
আর এখানে আসলেই এআইয়ের ব্যবহার হল কি না সেটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষের অস্বস্তি তৈরি হয় কেবল এআই ব্যবহারের সন্দেহ থেকে।
এ গবেষণার সহলেখক ও ‘কর্নেল ইউনিভার্সিটি’র ইনফরমেশন সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক মাল্টে জং বলেছেন, ‘আমরা মানুষের কথা শুনে অনেক কিছু ধারণা করি, আর মানুষের ভাষার ধরনই আমাদের মনে সেই ধারণা তৈরি করে দেয়।’
‘কর্নেল টেক’-এর ইনফরমেশন সায়েন্সের অধ্যাপক মোর নামান বলছেন, এখানে একটা অদ্ভুত দোটানা কাজ করছে। একদিকে এআই আমাদের যোগাযোগ সুন্দর ও সহজ করে দিচ্ছে। আবার একইসঙ্গে সন্দেহ ও অবিশ্বাসও বাড়াচ্ছে। এ বিষয়টি গভীর এক আস্থার সংকট তৈরি করেছে আমাদের মধ্যে।
তিনি বলেছেন, এআই ব্যবহারের ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের ‘মানবীয় সংকেত’ হারিয়ে ফেলছেন মানুষ। প্রথমটি হচ্ছে ‘মানবিক সংকেত’, যেটি মানুষের ভেতরের মানুষটাকে প্রকাশ করে। যেমন– দুর্বল মুহূর্তের স্বীকারোক্তি, ছোট ছোট ব্যক্তিগত অভ্যাস বা অভিব্যক্তি। যেমন– অন্যকে বলা, “এই হচ্ছে আমি, আমি একজন মানুষ”।
দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘মনোযোগ ও প্রচেষ্টার সংকেত’, যেটি বোঝায় “আমি নিজের হাতে সময় নিয়ে তোমার জন্য এটি লিখেছি।” এসব বিষয় ছোট হলেও এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, কেউ কাউকে গুরুত্ব দিয়ে লেখাটি লিখেছেন, কোথাও থেকে কপিপেস্ট করে নয়।
সবশেষ তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘দক্ষতা বা ব্যক্তিত্বের সংকেত’, যেমন মানুষের রসবোধ, চিন্তা করার সক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব অন্যদের কাছে মানুষের বাস্তবতা প্রদর্শন করে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক নামান উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি দুঃখিত, তোমার মন খারাপ’ বনাম ‘আমি দুঃখিত, রাতের খাবারের জন্য হঠাৎ করে খুব বেশি রেগে গিয়েছিলাম আমি, আমার সম্ভবত এই সপ্তাহে থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া উচিত ছিল’।
এখানে প্রথমটা শুনতে ভদ্র তবে একেবারে নীরস, যেন এআই লিখেছে। তবে দ্বিতীয়টি একদম মানুষের মতো করে বলা শোনাচ্ছে। কারণ সেখানে আছে অপরাধবোধ, ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি ও আবেগের রং।
নামান আরও বলেছেন, এআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের এ নতুন দুনিয়ার ভবিষ্যৎ পথ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে থেকে যেসব মানবিক সংকেত হারিয়ে গিয়েছে সেগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনা এবং এসব বিষয়কে আরও গুরুত্ব দেওয়া।
কারণ সমস্যা কেবল মানুষের ভাষা বদলে যাওয়ার নয়, বরং ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তাধারাও বদলে দিচ্ছে এআই।
তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, “আজকাল ডেটিং অ্যাপে কেউ যদি প্রোফাইলে মজার কিছু লেখেন আমরা কীভাবে জানব ওটা তিনিই লিখেছেন না কি এআই লিখে দিয়েছে? তাহলে বর্তমানে প্রোফাইলে বা চ্যাটিংয়ে মজা করার মানে আসলে কী?”
মানুষ ধীরে ধীরে নিজের মতো করে ভাবা ও প্রকাশের বিষয়টিই ভুলে যাচ্ছেন– আর এ জায়গাটিই তাকে সবচেয়ে ভাবিয়ে তোলে উল্লেখ করে নামান বলেছেন, ‘আমরা এখন নিজের ভাবনা বলার বদলে এআই যেভাবে আমাদের বলায় সাহায্য করছে ঠিক সেইভাবেই আমরা বলছি। ফলে এআইয়ের ভাষায় আরও সহজে প্রভাবিত হয়ে পড়ছি আমরা।’
নামান সতর্ক করে বলেছেন, মানুষের নিজের বলার সক্ষমতা হারিয়ে গেলে মানুষ কেবল মুখোমুখি কথা বলাকেই বিশ্বাস করতে পারবেন, এমনকি ভিডিও কলেও কথা বলতে অসুবিধে হবে তাদের।
গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে ঠিক কী রকম হবে বা সবাই একই রকমভাবে কথা বলবেন না কি খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আলাদা স্টাইল থাকবে মানুষের সেটা আগে থেকে বলা মুশকিল। সবকিছু নির্ভর করছে আমরা নিজেরা এমন পরিবর্তনের সচেতন অংশীদার হব কি না তার ওপর।
এখনও এমন কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যেখানে এআইয়ের প্রভাব খুব চোখে পড়লে মানুষ কিছুটা বিরক্ত বা সতর্ক হয়ে ওঠেন। এদিকে আবার প্রযুক্তি এমন দিকেও এগোচ্ছে, যেখানে মানুষের বৈচিত্র্যকে আরও ভালোভাবে অনুকরণ করতে পারবে এআই।
ভার্জ লিখেছে, এআই মানুষের ভাষা বদলে দেবেই। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি নিজেরা চেষ্টা করব আমাদের ভাষার সেই অগোছালো আবেগ, ছোট ছোট ব্যতিক্রমী বিষয় ও নিজস্ব ঢংগুলোকে ধরে রাখতে– যেগুলো মূলত মানুষকে মানুষ করে তোলে?
মানুষের কথা বলার এই ‘ঝাঁঝ, এই গড়বড় ভাষাটাই’ তো আসলে জীবন্ত যোগাযোগের প্রমাণ, যা কোনও এআই’ই পুরোপুরি কপি করতে পারবে না কখনো, কারণ সেটা অপরিকল্পিতভাবে একেবারেই অনুভূতির বিষয়। সূত্র: বিডিনিউজ