​ কোভিড মহামারীর নতুন উপকেন্দ্র ইন্দোনেশিয়া

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০২১, ১৬:২৯

যাযাদি ডেস্ক

 

 

হাসপাতালের হলওয়ে, তাঁবু আর গাড়িতে হাজার হাজার রোগী শুয়ে আছে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে তারা অপেক্ষা করছে ভিড়ে ঠাসা হাসপাতাল যদি একটি শয্যা পাওয়া যায়।

 

শয্যা পাওয়ার ভাগ্য যদি কারও হয়ও, সেখানে অক্সিজেন মিলবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই। আরও বহু মানুষ কোভিড উপসর্গ নিয়ে বাড়িতেই বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ।

 

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারীর নতুন উপকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ইন্দোনেশিয়া। দৈনিক গড় শনাক্ত রোগীর হিসাবে বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল এ দেশটি এখন ভারত ও ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানটি দখল করেছে।

 

ইন্দোনেশিয়াজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার বাড়ছিল জুন মাস থেকেই। জুলাইয়ে এসে তা ভয়াবহ রূপ পেয়েছে। রোগী যেখানেই শয্যাশায়ী থাকুক, করোনাভাইরাস নিঃশ্বব্দে তাদের শ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেনের সন্ধানে স্বজনেরা পাগলের মত ছুটোছুটি করছেন, সফল হচ্ছেন কমই।

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের চলমান ঊর্ধ্বগতিতে হাজারের বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এ দেশটিও বাদ পড়েনি। টিকাদানের হারও ইন্দোনেশিয়ায় বেশ কম।

 

এ বছরের প্রথমভাগেও এ অঞ্চলের দেশগুলো মহামারীর বিস্তার বেশ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু সেই বাঁধ আর টেকেনি।

 

ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মিয়ানমান ও থাইল্যান্ডের প্রশাসনও এখন সবচেয়ে বেশি কোভিড রোগী সামাল দিচ্ছে; সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনসহ নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপে বাধ্য হচ্ছে।

 

সিএনএনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মহামারী শুরুর পর গত বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল ইন্দোনেশিয়ার প্রশাসন। কিন্তু করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরন সেখানে ছড়িয়ে পড়ে জুন মাসে।

 

এরপর সেখানে রোগীর সংখ্যায় ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা দেয়। বিশেষ করে জনবহুল জাভা ও বালি দ্বীপে ব্যাপক হারে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে।

 

সেদেশের অনেক অঞ্চলেই রোগীর সংখ্যাধিক্য স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। হাসপাতালগুলো সামর্থ্য বাড়াতে জরুরি পদক্ষেপ নিচ্ছে।

 

বেকাশি রিজিওনাল পাবলিক হসপিটালে রোগীর চাপ সামলাতে বিশাল তাঁবু খাটানো হয়েছে, সেখানে বাড়তি দেড়শ শয্যার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

 

রাজধানী জাকার্তার কাছে একটি ছোট ওষুধের দোকানের সামনে দীর্ঘ সারিতে মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে, তারা অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে এসেছেন ভরার জন্য।

 

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সতর্ক করে বলেছে, ইন্দোনেশিয়া ‘কোভিড বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত’।

 

এ মাসের শুরুতে ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বুদি গুনাদি সাদিকিন বলেন, গত ঈদের ছুটির পরপরই সেদেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে। আর সেজন্য অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনই দায়ী, যা প্রথম ভারতে শনাক্ত হয়।

 

জুলাইয়ের ১০ তারিখ থেকে ইন্দোনেশিয়ায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে তখন গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছিল।

 

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কোভিড নিয়ন্ত্রণে তারা সব সম্পদ ব্যবহার করছে, সরবরাহ বাড়াতে অন্য দেশ থেকে অক্সিজেন আনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

ইন্দোনেশিয়ার প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সেখানে ৫৭ হাজার নতুন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়, যা সেদেশে এ পর্যন্ত একদিনে শনাক্তের রেকর্ড। এই সংখ্যা এক মাস আগের তুলনায় সাত গুণ বেশি।

 

শুক্রবার সেখানে কোভিড রোগীদের মধ্যে ১ হাজার ২০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মহামারী শুরুর পর এ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি হিসাবে ৭১ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরও আগেই লকডাউন জারি না করার মূল্য দিতে হচ্ছে ইন্দোনেশিয়াকে। শনাক্ত-মৃত্যুর যে হিসাব বর্তমানে সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হচ্ছে, বাস্তবে অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।

 

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে ইন্দোনেশিয়ায় যত জনের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার মধ্যে ২৭ শতাংশের বেশি পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে। এই হার এখন বিশ্বে অন্যতম বেশি। এখনও অনেক রোগীই নমুনা পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

 

গত শনিবার প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাকার্তার বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেকই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, যা এই সমীক্ষা চালানোর সময় রাজধানীতে আক্রান্তের সরকারি হিসাবের ১২ গুণ বেশি।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া অনেক প্রদেশই উপযুক্ত সময়ে নিশ্চিত হওয়া রোগীদের আলাদা করতে পারছে না।

 

ইন্দোনেশিয়ায় মহামারী নিয়ন্ত্রণে আরেকটি বড় সংকট হলো বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিস্তার। কয়েক মাস ধরে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় কোভিড-১৯ চিকিৎসা ‘অকার্যকর’ বলে ভুয়া বার্তা ছাড়ানো হয়েছে।

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকা নিয়ে গুজব ছড়ানোর কারণে অনেকেই টিকার ডোজ নিতে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। তাদের ভয়, কোভিডের টিকা নিলে তারা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হতে পারেন বা মারা যেতে পারেন, যার কোনো ভিত্তি নেই।

 

এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে, ইন্দোনেশিয়ায় অনেকেই কোভিড-১৯ রোগটিকে গুরুত্ব দেননি এবং এখনও দিচ্ছেন না, এমনকী তাদের চারপাশে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ার পরেও।

 

অনেকে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরেও একে মৌসুমি সর্দি-ঠাণ্ডা হিসেবে হালকাভাবে নিয়েছেন। অনেক পরীবারে কমবয়সীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দিলেও তাদের পরীক্ষা করানো হয়নি। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি।

 

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি ভারতে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে। অথচ পরিস্থিতি সামলানোর মত যথেষ্ট সম্পদ নেই।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্দোনেশিয়ায় চলমান সংক্রমণের ঢেউি এখনও শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছেনি। পরিস্থিতি আরও খারাপের আশঙ্কা করছেন তারা।

 

সেদেশের প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো গত বুধবার বলেছেন, মহামারীর এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে ইন্দোনেশিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় জাগাতে পারে টিকা।

 

‘সব নাগরিকের টিকা পাওয়ার ন্যায্য ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশে এখনও টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে।’

 

আন্তর্জাতিক কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় মঙ্গলবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩০ লাখ ডোজ টিকা সেখানে পৌঁছানোর কথা। এটা হবে সেদেশে করোনাভাইরাসের টিকার অষ্টম চালান। কোভ্যাক্সের আওতায় ইন্দোনেশিয়া এ পর্যন্ত এক কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে।

 

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার ২৭ কোটি মানুষের মাত্র ১৫ শতাংশ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের এক ডোজ টিকা পেয়েছে। আর পুরো দুই ডোজ টিকা পেয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ।

 

ইন্দোনেশিয়া টিকার জন্য চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাক বায়োটেকের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছিল, যা অন্যান্য টিকার তুলনায় কম কার্যকর বলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। সেদেশে অন্তত ২০ জন চিকিৎসক সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও করোনাভাইরাসে মারা গেছেন।

 

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র মডার্নার ৪৫ লাখ ডোজ কোভিড টিকা পাঠিয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের ১৫ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বুস্টার ডোজ হিসেবে ওই টিকা দেওয়া হবে।

 

ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাদিকিন শুক্রবার জানিয়েছেন, তারা নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়েছেন এবং এখন দিনে ২ লাখ ৩০ হাজার লোকের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, গত ডিসেম্বরে এই সংখ্যা ছিলো ৩০ হাজার। এখন দিনে ৪ লাখ মানুষের নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্য ঠিক করেছেন তারা।

 

যাযাদি/এসআই