চীনের মানচিত্রে অরুণাচল, ভারতকে কঠিন বার্তা

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৫

যাযাদি ডেস্ক
চীনের প্রকাশ করা সেই নতুন মানচিত্র - ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানীতে মিলিন হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সেখানে তারা একমত হন যে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধগুলো মিটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু সেই সমঝোতার দুই না পেরোতে চীনের নতুন মানচিত্রে অরুণাচলকে অন্তর্ভূক্ত করে কঠিন বার্তা দিলো ভারতকে। এই নিয়ে আবারো দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিতে পারো। 

জানা যায়,  গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার তাদের দেশের নতুন মানচিত্রে এই প্রথমবারের মতো ভারতের সমগ্র অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যটিকে অন্তর্ভুক্ত করে দেখিয়েছে – যাকে ঘিরে বেইজিং ও দিল্লির মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।

শুধু অরুণাচলই নয়, ‘আকসাই চিন’ নামে লাদাখ-সংলগ্ন যে ভূখণ্ডটিকে ভারত নিজেদের বলে দাবি করে থাকে সেটিও চীনের এই নতুন ম্যাপে জায়গা করে নিয়েছে।

এই মানচিত্র প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মন্তব্য করেছেন, ‘কেউ একটা আজগুবি দাবি করলেই অন্যের ভূখণ্ড তার হয়ে যায় না!’

ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভি-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে এটিকে চীনের ‘পুরনো একটা বদভ্যাস’ বলেও বর্ণনা করেছেন তিনি।

চীনের এই মানচিত্র প্রকাশ করা হলো এমন একটি সময়ে, যার দিনচারেক আগেই জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হয়েছে।

এমনকি, আগামী সপ্তাহে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আমন্ত্রণে চীনা প্রেসিডেন্টের দিল্লিতে আসারও কথা রয়েছে।

ফলে দু’দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত থাকলেও সীমান্তে বা কূটনৈতিক পর্যায়ে যে উত্তেজনা রয়েই গেছে, চীনের নতুন এই ম্যাপকে পর্যবেক্ষকরা তারই সবশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন।

সাম্প্রতিক অতীতে ভারত একাধিকবার বলেছে অরুণাচল কখনোই একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড নয় – বরং তা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ভারতের বিভিন্ন বিরোধী দল অবশ্য এর মধ্যেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে, চীন যেখানে একটার পর একটা উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে তখন চীনের প্রেসিডেন্টকে দিল্লিতে ‘আপ্যায়ন’ করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে।

বিজেপি নেতা সুব্রমনিয়ান স্বামী আবার এই বিতর্কে সরাসরি নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করে লিখেছেন, ‘ভারত মাতার অখণ্ডতা রক্ষা করতে না-পারলে আপনিই বরং সরে দাঁড়ান!’

জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনের যখন আর দিনদশেকও বাকি নেই, তখন চীনের এই ধরনের পদক্ষেপ যে ভারতকে প্রবল কূটনৈতিক অস্বস্তিতে ফেলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কী আছে এই নতুন মানচিত্রে?
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ সোমবার (২৮ অগাস্ট) জানায়, সে দেশের ‘স্ট্যান্ডার্ড ম্যাপে’র ২০২৩ সংস্করণ সে দিনই প্রকাশ করা হয়েছে এবং চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তা লঞ্চও করা হয়েছে।

ওই নতুন ম্যাপের ছবি পোস্ট করে আরো জানানো হয়, চীন-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের ‘জাতীয় সীমানা’ আঁকার জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে, সেই একই পদ্ধতিতে এই মানচিত্রটিও সংকলন করা হয়েছে।

ওই মানচিত্রটিতে ভারতের পুরো অরুণাচল প্রদেশ অঙ্গরাজ্যটি এবং ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর চীনের দখলে চলে যাওয়া ‘আকসাই চীন’কে সে দেশের অংশ হিসেবে দেখানো হয়।

এছাড়া তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরের ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’-কেও নিজেদের ম্যাপের ভেতরে দেখিয়ে ওই দুই অঞ্চলের ওপরেও এক ধরনের অধিকার দাবির চেষ্টা করা হয়।

ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত অরুণাচল প্রদেশকে চীন অবশ্য বহুদিন ধরেই একটি ‘বিতর্কিত ভূখণ্ড’ হিসেবে দাবি করে আসছে। তারা বলে থাকে অরুণাচল হলো আসলে দক্ষিণ তিব্বতেরই একটা অংশ।

অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দা কোনো ভারতীয় নাগরিক চীনের ভিসার জন্য আবেদন করলেও তাদের পাসপোর্টে ছাপ না-মেরে চীন স্টেপল করা একটি কাগজে ভিসা দিয়ে থাকে – ভারত বহুদিন ধরেই যে রীতির প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।

অর্থাৎ এই ‘স্টেপলড ভিসা’র মাধ্যমে চীন বোঝাতে চায় অরুণাচলের বাসিন্দাদের তারা ভারতের নাগরিক বলে মনেই করে না।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের সরকারি ম্যাপে গোটা রাজ্যটাকেই চীনের অংশ হিসেবে দেখানোর ঘটনা এই প্রথম ঘটল।

এর আগে গত এপ্রিল মাসেই চীনের পক্ষ থেকে অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন জায়গার চীনা বা তিব্বতি নাম ঘোষণা করা হয়েছিল, ভারতের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী তখন বলেছিলেন, ‘কোনো দেশ একটা জায়গার কাল্পনিক নাম দিলেই সেটা তাদের হয়ে যায় না। অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, আছে ও থাকবে।’

অনেকটা একই সুরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও আজ চীনের প্রচেষ্টাকে খণ্ডন করতে চেয়েছেন।

তবে অরুণাচল প্রদেশের ওপর নানাভাবে নিজেদের দাবি জানিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় চীন যে বিরাম দিতে রাজি নয়, তাদের সবশেষ এই পদক্ষেপেই তা স্পষ্ট।

‘কার্টোগ্রাফিক অ্যাগ্রেশন’
ভারতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে যে ধরনের ‘প্ররোচনামূলক’ পদক্ষেপ নিয়ে চীন ভারতকে তাতাতে চাইছে কূটনৈতিক পরিভাষায় তাকে বলে ‘কার্টোগ্রাফিক অ্যাগ্রেশন’ বা মানচিত্র দিয়ে আগ্রাসন।

দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে চাইনিজ স্টাডিজের অধ্যাপক শ্রীকান্ত কোন্ডাপাল্লির কথায়, ‘এটা মোটেই ভুল করে করা হয়নি।’

‘বরং প্রতিবেশী যে প্রায় আঠারোটি দেশের সাথে চীনের স্থল বা সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ আছে, তাদের অনেকের সাথেই চীন ইচ্ছাকৃতভাবে বহুদিন ধরে এ জিনিস করে আসছে,’ তিনি বলেন।

তবে ভারতের পক্ষে এটা আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে এই কারণে যে দেশের বিরোধী দলগুলো বহুদিন ধরেই বলে আসছে, সীমান্ত অঞ্চলে প্রায় ২০০০ বর্গকিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড চীনের দখলে চলে গেছে বলে তাদের ধারণা।

কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা রাহুল গান্ধী গত সপ্তাহে লাদাখে গিয়েও একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেছেন।

চীনের নতুন ম্যাপ প্রকাশের পর কংগ্রেস নেতা ও এমপি মনীশ তিওয়ারি এদিন বলেন, ‘মোদী সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত চীনের দখলে যাওয়া এলাকা আগে খালি করা।’

‘সেই জায়গায় চীনা প্রেসিডেন্টকে দিল্লিতে আপ্যায়ন করাটা কতটা উচিত, সেটাও ভাবা দরকার!’

শিবসেনা (উদ্ধব) গোষ্ঠীর এমপি সঞ্জয় রাউত মন্তব্য করেন, ‘চীন আমাদের জমি দখল করে নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এখন তারা অরুণাচলকেও গ্রাস করতে চায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘হিম্মত থাকলে’ সরকারের এখনই চীনের ভেতরেও ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালানো উচিত – যেমনটা আগে পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও করা হয়েছিল।

বস্তুত অনেক পর্যবেক্ষকই ধারণা করছেন, সীমান্ত অঞ্চলে চীন ভারতের এলাকা সত্যিই দখল করেছে কিনা, তা নিয়ে ভারতে বেশ কিছুদিন ধরে যে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে সেটাকে আরো উসকে দিতেই বেজিং এই নতুন ম্যাপ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সূত্র : বিবিসি

যাযাদি/ এস