হাসিনাত্তোর বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ একের পর এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে বলে রিপোর্ট করেছে জার্মানির বনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল দি মিরর এশিয়া।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের প্রথম প্রোজেক্ট ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য। এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হলো বামপন্থীদের মাধ্যমে ইউনূস সরকারের ওপর হেফাজত শিবির ও হিজবুত তাহরির ভর করেছে এমন বয়ান হাজির করানো। সেই সাথে ‘র’ এর সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ রয়েছে হেফাজত ইসলামের এমন অংশদের বোঝানো যে, ‘ড. ইউনূস সুদখোর, তিনি মার্কিন এজেন্ট, কোনোভাবে ভালো মুসলিম নন। কিছুদিন গেলে এই সরকার সমকামীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে।’ এই গ্রুপকে জামায়াতের সাথে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ঐক্যে না যাওয়ার জন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মুহূর্তে ভারতের অগ্রাধিকার হলো- তরুণদের কোনো দল গঠনের সুযোগ না দিয়ে বর্তমান সরকারকে নভেম্বরের মধ্যে হিজবুত তাহরির ও শিবির প্রভাবিত সরকার বলে চিহ্নিত করে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করা। অন্য দিকে নির্বাচনের পরিবেশের কথা বলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিয়ে আসা।
মিরর এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতোমধ্যে ‘র’ এর মধ্যে একটি উপ-গ্রুপ করা হয়েছে ‘বাংলা মিশন’ সম্পন্ন করার জন্য। সম্প্রতি চিকেন নেক নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর মন্তব্য ও সেভেন সিস্টার নিয়ে সমন্বয়কদের কারো কারো বক্তব্যকেও আমলে নিয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত গোয়েন্দা উপ-টিম ‘বাংলা মিশন’।
তাদের প্রত্যেকের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে হিন্দি ও ইংরেজিতে অনুবাদ করে ভিক্টর-২ এর টেবিলে দেয়া হয়েছে। ভিক্টর-২ হলো ‘র’ এর একটি সেল যেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। পত্রিকাটির মতে, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত এই মুহূর্তে দুই নৌকায় পা রেখে চলছে।
ঢাকার নতুন সরকার ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গতিবিধি নজরদারির পাশাপাশি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য কূটনীতিকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, তারা জামায়াতে ইসলামীর সাথে আলোচনার ‘দরজা’ এখনই খুলতে চায় না, তবে ‘জানালা’ খুলতে চায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনকারী সমন্বয়কদের নিয়ে ও তাদের আদর্শিক ধারণা নিয়ে দিল্লির দু’টি ও আসামের একটি থিংক ট্যাংক গত ২০ দিন ধরে গবেষণা করেছে।
তিনটি সংস্থার রিপোর্ট বলছে, সমন্বয়করা যে দল গঠন করতে যাবে তা হবে একটি ভারতবিরোধী রাজনৈতিক দল। বামপন্থী বৈপ্লবিক ধারণা তারা পোষণ করলেও তাদের সাথে ধর্মের বিরোধ থাকবে না। এই আদর্শের ফলে মূলত দেশের বামপন্থীদের রাজনৈতিক স্পেস একেবারে শূন্য হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করছেন গবেষকরা। ফলে তারা বামদের সাথে তরুণদের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে বলে ধারণা করছেন। সে চিন্তা থেকেই ‘র’ বামপন্থী ছাত্র নেতাদের সাথে যোগাযোগ করছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি হয়ে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানের তারা একটি দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি দিতে চাইলে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র বয়ান ক্ষুণœ হবে বলে মনে করছেন তারা, যা ঢাকায় ভারতের সফট পাওয়ারকে দুর্বল করে দেবে। এই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে বৃহত্তর পরিসরে গ্রহণ করা হলে, ‘র’ এর দ্বিতীয় পরিকল্পনা ‘রিসেটেল আওয়ামী লীগ-২০২৫’-ও খুব কঠিন হয়ে যাবে।
মিরর এশিয়া ভারতের পরবর্তী পরিকল্পনা কী হতে পারে, তা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান করে দেখতে পায়, সম্প্রতি হাসিনাকে সাউথ দিল্লির একটি সরকারি আবাসিকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, হাসিনা বর্তমানে ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) সুরক্ষিত একটি ভবনে থাকছেন। অতি সম্প্রতি ভারতের ডজনখানেক হাই-প্রোফাইল মিটিং হয়েছে তার সাথে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ‘র’ প্রধান নিজে শেখ হাসিনার দেখভাল করছেন এবং তার সাথে প্রায়ই বৈঠক করছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য তার সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছে তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। নিয়মিত যোগব্যায়ামও করছেন হাসিনা। হাসিনার নতুন বাসভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নিয়োগ দেখে দিল্লিতে কর্মরত এক বাঙালি সাংবাদিক দ্য মিরর এশিয়াকে বলেছেন, হাসিনা দিল্লিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবেন।
দিল্লিভিত্তিক একজন বাংলাদেশবিষয়ক গবেষক দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, হাসিনার অসাধারণ ক্ষমতা আছে কামব্যাক করার। তিনি ’৮১-তে ও ’৯৬-তে কামব্যাক করেছেন। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গিয়ে তিনি ২০০৯ সালে অপ্রতিরোধ্যভাবে ফিরে এসেছেন। তার ধারণা- হাসিনা ফিরতে পারবেন আবার, হয়তো দিল্লি থেকে তিনি দল পরিচালনা করবেন। তবে সেখানে সঙ্কট হবে গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাসকে জাতীয় ইতিহাস, সাহিত্যকর্মের অংশ করে একটি আদর্শিক ভিত্তি তৈরি করলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত ছাত্রদের বেশি সময় দিতে চায় না। দিল্লি মনে করছে, বিএনপি আমলে বরং আওয়ামী লীগ বেশি নিরাপদ থাকবে। বিএনপির নানা সঙ্কট সামনে চলে এলে, বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে আওয়ামী লীগ একটা পলিটিক্যাল স্পেস পেতে পারে। মিরর এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৬ জুলাই যখন হাসিনা সরকার শিক্ষার্থীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেন, তখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে চলে যায়। পরে শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধ ও ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সরাসরি তদারকিতে বাংলাদেশে ‘র’ এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪০০ কর্মকর্তা ঢাকায় যান। তাদের ভাষায়, কাশ্মীরি কায়দায় আন্দোলন দমন করে তারা দিল্লি ফেরেন ২৮ জুলাই। মিরর এশিয়ার ভাষ্যমতে, পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ‘র’ ওয়াকিবহাল ছিল না। তারা সিআইএর কৌশলের কাছে হেরে যায় ৫ আগস্ট। যদিও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দিল্লি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেয়া নয়। ২ আগস্ট প্ল্যান ‘সি’ এর অংশ হিসেবে এই পরিকল্পনা করে রাখে হাসিনা ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে তার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চল হিসেবে দেখে, ফলে এসব দেশের ব্যাপারে নিরাপত্তা উপদেষ্টার একটা হস্তক্ষেপ থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘র’ ৫ আগস্টের পর ১০ আগস্ট সংখ্যালঘুদের সমাবেশের আড়ালে একটি প্রতিবিপ্লব করার পরিকল্পনা করে। তার জন্য বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সাংবাদিকও সেদিন ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। সেটি ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় ক্যুর পরিকল্পনা করা হয় ১৫ আগস্ট। সেটিও ব্যর্থ হয়। তবে সম্প্রতি দেশে যে আনসার বিদ্রোহের পরিকল্পনা হয়, তা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণভাবে নেয়া। তার সাথে ‘র’ এর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি দ্য মিরর এশিয়া।
মিরর এশিয়া হাসিনা ও ভারতের পরবর্তী পরিকল্পনার দিকে নজর রাখছে বলে উল্লেখ করে বলেছে, এজন্য বাংলাদেশের ওপর নজর রাখেন এমন দুই সাংবাদিক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা, দু’জন থিংক ট্যাংকের গবেষক ও সিক্রেট সার্ভিসের একজনের সাথেও কথা বলেছে মিরর এশিয়া। মিরর এশিয়ার সাথে আসাম থেকে একজন বাংলাদেশ এক্সপার্ট কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হাসিনা নর্থ ইস্টের সাথে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার যে কথা বলছিলেন, সে স্বপ্ন একেবারে ভেঙে গেছে। বিএনপি এ ক্ষেত্রে ভারতকে সহযোগিতা করবে না। নতুন রাজনৈতিক দল হবে অনেক বেশি তারুণ্যনির্ভর, তারা কূটনীতির চেয়ে রাজনৈতিক ভাষায় বেশি কথা বলবেন। এমনকি তাদের কিছু সিদ্ধান্ত সেভেন সিস্টারের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
যাযাদি/ এস