দ. এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা: চরম বেকায়দায় ভারত

প্রকাশ | ২২ মে ২০২৫, ০০:৩৫

যাযাদি ডেস্ক
ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছে।

ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছে। 

এই সংঘাত শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছে কূটনীতি, বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক জোট গঠনের নানা পরিসরে। 

ভারতের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক কর্তৃত্ব এই মুহূর্তে প্রবল প্রশ্নের মুখে, যেখানে একদিকে চিরবৈরী পাকিস্তান নতুন কৌশলে এগোচ্ছে, অন্যদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও ভারতকে দুই দিক থেকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। 

সেই সঙ্গে মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন-এই সব মিলিয়ে ভারতের আঞ্চলিক কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে।

চার দিনের সামরিক সংঘাতের পর পাকিস্তান দাবি করেছে যে তারা ভারতের ছয়টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে যাদের মধ্যে কমপক্ষে দুটি ফ্রান্সের তৈরি মাল্টিরোল অত্যাধুনিক রাফায়েল। 

প্রতীকী পুরস্কার হিসেবে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে মঙ্গলবার (২০ মে) সর্বোচ্চ সামরিক মর্যাদা ‘ফিল্ড মার্শাল’ উপাধি দেয়া হয়েছে। 

ইসলামাবাদ এর মধ্য দিয়ে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, মনস্তাত্ত্বিক ও কূটনৈতিক স্তরেও জয় দাবি করছে। 

এদিকে, পাকিস্তান কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের দিকে কূটনৈতিক হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর করাচি থেকে একটি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর মাধ্যমে এই যোগাযোগ ফের চালু হয়। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের পোর্ট কাসিম থেকে সরকারিভাবে অনুমোদিত একটি কার্গো জাহাজ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, যা দুই দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যের সূচনা করে।

সেই সঙ্গে, দীর্ঘ ৯ বছর পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় শুরু হচ্ছে। 

চলতি মাসের ১৯ তারিখ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) পাকিস্তানের বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা এয়ার সিয়ালকে ঢাকা-করাচি রুটে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন দেয়। 

এর আগে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাই জিন্নাহ নামক আরেকটি পাকিস্তানি এয়ারলাইনস একই রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায়। 

ঢাকার সঙ্গে সামরিক মহড়ায় একত্রে অংশগ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামাবাদের কৌশলগত অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে।

ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনের মুখে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কট্টরপন্থি বিজেপি সরকারের সম্পর্কে ছেদ প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। 

ভারতে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ইস্যুতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া প্রতিক্রিয়ার কারণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার কৌশলগত ভুল করছে। এতে আঞ্চলিক বন্ধুত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক উষ্ণ হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজ আসার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ জোরদার হচ্ছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগত অস্বস্তির কারণ।

এদিকে, মালদ্বীপ ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে চীনমুখি হয়ে উঠেছে।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু দেশটিতে ভারতের সামরিক উপস্থিতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য হস্তক্ষেপ’ বলে আখ্যা দিয়ে ভারতবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। 

আঞ্চলিক আধিপত্যবাদে ভারতের জন্যে সবচেয়ে বড় হুমকি চীনের সঙ্গে  প্রতিরক্ষা ও অবকাঠামো চুক্তি নবায়ন করেছেন মুইজ্জু। 

এতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার নতুন বাস্তবতায় চতুর্মুখী চাপে চরম বেকায়দায় ভারত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান স্পষ্টতই সংকটাপন্ন- পাকিস্তানের সামরিক ও কূটনৈতিক অগ্রগতি, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভাঙন, মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা প্রকট হচ্ছে। সেই সঙ্গে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার নির্লিপ্ত অবস্থান। সবমিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য আর বিদ্যমান নেই বলেই অনেকে মনে করছেন। 

এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এটি কেবল একটি সামরিক বিজয় নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক পাল্টা আঘাত-যেখানে ভারতের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।’

ভারতের মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ড. স্মৃতি এস. পট্টনায়েক বলেন, ‘ভারত যদি প্রতিবেশীদের সঙ্গে পুরোনো ভাষায় কথা বলতে চায়, তবে নতুন বাস্তবতা তার সামনে দরজা বন্ধ করে দেবে।’

কারা সুবিধাজনক অবস্থানে

ভারত উপমহাদেশে এই বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান। 

যুদ্ধক্ষেত্র ও কূটনৈতিক অঙ্গন দুই অবস্থানে চিরবৈরী নয়াদিল্লিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ইসলামাবাদ।

আঞ্চলিক রাজনীতিতে  ভারতের প্রভাববলয় কমে যাওয়ায় শূন্যস্থান পূরণ করে নিচ্ছে চীন এবং ঘনিষ্ঠমিত্র পাকিস্তান। বহুপাক্ষিক ভারসাম্য বজায় রেখে কৌশলগত সুবিধা আদায়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের জন্যও। 

ভারত-চীন চিরবৈরিতার মাঝে জাতীয় স্বার্থ আদায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মালদ্বীপ। 

চার দিনের সামরিক সংঘাতের পর দক্ষিণ এশিয়ার নতুন সমীকরণ এবং ভূরাজনীতিতে ভারত কঠিন সময় পার করছে।

একদিকে, যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানের রণকৌশলের কাছে বিপর্যস্ত, অন্যদিকে কূটনৈতিক অঙ্গনে কোনঠাসা। 

প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া মোদি সরকার এবং ভারত নতুন করে আঞ্চলিক ভারসাম্য নিজের পক্ষে আনতে পারবে না। 

এদিকে, পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর জন্য কৌশলগত অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ এনে দিয়েছে।

তাদেরকে জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে, বড় শক্তির প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।