পাকিস্তান-তুরস্ক-চীনের শত্রু ভারত
প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২৫, ২১:১৮

নয়াদিল্লি যখন অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত পুনর্গঠনে মনোযোগী, তখন সমুদ্রপথে তার নিরাপত্তা ব্যূহ ভেঙে দেওয়ার মতো এক অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ রূপ নিচ্ছে।
এই চ্যালেঞ্জ আগামী এক বা দু দশকের মধ্যেই বাস্তব হয়ে উঠতে পারে। ২০৪০ সালের মধ্যে ভারতকে মোকাবিলা করতে হতে পারে এক সমন্বিত সামুদ্রিক জোট, যার নেতৃত্বে থাকবে চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তান।
এই ত্রয়ী দেশ সরাসরি কোনো সামরিক জোটে আবদ্ধ না হলেও, একে অপরের সঙ্গে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার হাতে হাত রেখে যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে একে ‘ডি-ফ্যাক্টো’ নেভাল অ্যালায়েন্স বা কার্যত নৌ জোট বললেও অত্যুক্তি হবে না।
সানডেগার্ডিয়ানে লাইভে এমনি অভিনন্দন মিশ্র মন্তব্য করেছেন।
তিনি আরও লিখেছে, এই চিত্রটি বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে সাম্প্রতিক ‘অপারেশন সিদুঁর’-এর সময়।
‘অপারেশন সিদুঁর’ ছিল ভারতের নৌ, স্থল, আকাশ, সাইবার এবং মহাকাশ—সবচেয়ে বিস্তৃত এক যুদ্ধ নয়াদিল্লি যাকে ‘প্রতিরক্ষা মহড়া’ চিহ্নিত করতে চায়। নয়াদিল্লি আরো দাবি করে, মূলত একক অভিযানের ওপর ভিত্তি করেই এটি পরিচালিত হয়েছে।
বিপরীতে, এই সময় পাকিস্তানের সহায়তায় তুরস্ক এবং চীনের পরোক্ষ বা নেপথ্য উপস্থিতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠার দাবিও ভারত করে থাকে।
ভারতের নিজেকে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভাবতে ভালোবাসে। সে রকম আচরণও করে। কিন্তু ভবিষ্যতের প্রতিটি যুদ্ধেই একা লড়তে বাধ্য হয়, আর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে সুসংগঠিত ও বহুজাতিক, তবে এই অসমতা কেবল সামরিক ভারসাম্য নয়, কূটনৈতিক রণনীতি ও বৈশ্বিক অবস্থানকেও নড়বড়ে করে দিতে পারে। এমন হিসেবে নয়াদিল্লির মাথাব্যাথা হয়ে উঠছে।
চীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যেই তাদের নৌবাহিনী থাকবে ছয়টি বিমানবাহী রণতরী, বারোটি পরমাণু হামলায় সক্ষম ডুবোজাহাজ, ষাটটিরও বেশি প্রচলিত ও এআইপি (এয়ার-ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রপাশন, অর্থাৎ অক্সিজেনের জন্য ভেসে ওঠার দরকার পড়ে না ফলে দীর্ঘ সময় সাগরের তলে তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে।) ডুবোজাহাজ।
ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ডুবোজাহাজগুলোকে চলার জন্য দরকার অক্সিজেনের দরকার।
কিন্তু পানির নিচে অক্সিজেন নেই, তাই মাঝে মাঝেই ডুবোজাহাজকে পানির উপরে উঠে এসে শ্বাস মানে বাতাস নিতে হয়। একে বলে স্নোরকিলিং (snorkeling)। এই সময় ডুবোজাহার শত্রুর রাডারে ধরা পড়তে পারে। এআইপি প্রযুক্তিতে এমন ব্যবস্থা থাকে যা পানির নিচে থেকেই বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে, বাইরের বাতাস টানার দরকার হয় না।
সাধারণ ডিজেল ইঞ্জিন চালিত ডুবোজাহাজ সাধারণত ২–৩ দিন পানির নিচে থাকতে পারলেও এআইপি চালিত ডুবোজাহাজ এক নাগাড়ে পানির নিচে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ কাটাতে পারে।
এ ছাড়ও থাকে দেড় শতাধিক যুদ্ধজাহাজসহ এক বিপুল বহর ।
বাই দু উপগ্রহের মাধ্যমে চীন তাদের গোয়েন্দা নজরদারি ক্ষমতা এমন স্তরে নিয়ে গেছে, যেখানে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের মতো একটি বাণিজ্যিক স্থাপনাও এখন কার্যত একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
শুধু দক্ষিণ চীন সাগর নয়, আফ্রিকার জিবুতি ঘাঁটি, ভারত মহাসাগরের দ্বীপসমূহে চীনা প্রভাব, এমনকি মালাক্কা প্রণালীর ধারেকাছেও তাদের সক্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
তুরস্ক এই সময় নিজের সামুদ্রিক শক্তিকে নতুন আঙ্গিকে সাজাচ্ছে।
তাদের মিলজেম প্রকল্পের অধীনে টিএফ-২০০০ ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, মিলডেন স্টেলথ বা রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম ডুবোজাহাজ এবং নিজস্ব বিমানবাহী রণতরীসহ আধুনিক সামুদ্রিক সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে।
এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সশস্ত্র ড্রোন, রোবট-ডুবোজাহাজ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-চালিত নজরদারি প্রযুক্তি। শুধু তাই নয়, এইসব টেকনোলজি পাকিস্তানের সাথেও তুরস্ক ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
তুর্কি নির্মিত বাবর-ক্লাস করভেট পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে, যার কমব্যাট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আবার তুরস্কে তৈরি। একই সঙ্গে চীন থেকে তারা পাচ্ছে টাইপ ০৫৪এ/পি গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট ও হ্যাংগর-ক্লাস এআইপি ডুবোজাহাজ।
ফলে, ভারতে ভাবছে, পাকিস্তান নিজে প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকলেও এই দুই মিত্রের কল্যাণে সে এখন সাগর ভিত্তিক পরমাণু প্রতিহত বা ‘Sea-Based Nuclear Deterrence’-এর দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে।
এরই প্রতীক ‘বাবর-৩’ ডুবোজাহাজ-থেকে নিক্ষেপযোগ্য পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র।
এই তিন দেশ ২০৪০ সালের মধ্যে একটি সুসংগঠিত নৌ-গোছগাছ তৈরি করতে পারে। ভারত মনে করছে।
যেখানে একত্রে যুক্ত থাকবে ৮০টিরও বেশি ডুবোজাহাজ, সাতটি বিমানবাহী তরী, ২০০টির বেশি যুদ্ধজাহাজ।
এদের সবার সঙ্গে থাকবে বহু স্তরের ক্ষেপণাস্ত্র বা মাল্টি-লেভেল মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, একীভূত কমব্যাট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম,তাৎক্ষণিক গোয়েন্দা, নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ বা রিয়েল-টাইম আইসএসআর( ইটেলিজেন্স, সার্ভিলেন্স, রিকনিসান্স) এবং বেইদু উপগ্রহনের মাধ্যমে সংযুক্ত নেভিগেশন এবং নজরদারি ক্ষমতা।
ভারতের দিকে এই জোট তিনটি ভিন্ন ভৌগোলিক ফ্রন্ট থেকে চাপ তৈরি করতে পারে, আশংকা করছে নয়াদিল্লি।
চীন দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত-প্রশাস্তমহাসাগীর অঞ্চল থেকে, তুরস্ক লোহিত সাগর ও পূর্ব-মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আর পাকিস্তান আরব সাগর থেকে।
নয়াদিল্লি টের পাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে ভারতের বর্তমান প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়। বর্তমানে ভারতের হাতে ২৪টি ডুবোজাহাজ থাকলেও প্রযুক্তিগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে তা চীনের আধুনিকীকৃত ডুবোজাহাজ বহরের তুলনায় দুর্বল।
বিশেষত চীনের এআইপি ও পরমাণু হামলায় সক্ষম বা নিউক্লিয়ার অ্যাটাক ডুবোজাহাজ ভারতে থাকা ‘অরিহন্ত’ শ্রেণির এসএসবিএন-এর টহল সক্ষমতাকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ভারত ২০৪০ সালের বৈশ্বিক সামুদ্রিক দৃশ্যপটে প্রতিযোগিতামূলক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থানে থাকতে ইচ্ছুক।
এই খায়েসপূর্ণ করতে হলে তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে কেবল গতিশীল প্রতিরক্ষা নীতির দিকেই তাকে ঝুঁকতে হবে।
এই লক্ষ্য পূরণে প্রয়োজন আইএনএস বিশালের মতো ক্যাটোবার প্রযুক্তির বিমানবাহী তরী কা এয়ারক্রাফট কেরিয়ারের নির্মাণ শুরু, প্রকল্প এসএসএন-এর অধীনে ছয়টি পরমাণু হামলায় সক্ষম ডুবোজাহাজ নিউক্লিয়ার দ্রুত নিয়ে আসা, নিয়মিত অরিহন্ত টহল নিশ্চিত করা, প্রজেক্ট ৭৫আই-র অধীনে আধুনিক এআইপি ডুবোজাহাজ তৈরির গতি বাড়ানো, আন্দামান ও নিকোবর ঘাঁটিকে আক্রমণ-সক্ষম রূপে রূপান্তর এবং ভিয়েতনাম, ওমান ও রেইউনিয়নের মতো কৌশলগত অঞ্চলগুলোতে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করা।
সবচেয়ে বড় কথা, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি সোনার, টর্পেডো,ইউসিএভি এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সরঞ্জামগুলোকে আর গবেষণাগারে আটকে না রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে মাঠে নামানো।
এইসব পদক্ষেপ না নিলে ২০০টি যুদ্ধজাহাজ, ৩টি কেরিয়ার ব্যাটল গ্রুপ, ৫০০টি নৌবিমান—২০৩৫-৩৭ সালের মধ্যেই অর্জন করা কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।
এবং যদি ভারত প্রস্তুত না থাকে, তাহলে এই তিন দেশের জোট সমুদ্রের ঢেউয়ের নিচে ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে ডুবিয়ে দিতে পারে- আশংকায় হয়ত কাঁপছে নয়াদিল্লি।