গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল, সোচ্চার ইরানও
প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৫, ০৪:৫৯

ইরানে সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এসব হামলার নিশানা করা হচ্ছে ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, পারমাণবিক স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্র। গতকাল মঙ্গলবারও ইরানের সামরিক বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের হামলার পাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছে ইরানও।
গতকাল সংঘাতের পঞ্চম দিনেও দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের একটি সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অপারেশন পরিকল্পনা কেন্দ্রে হামলার দাবি করেছে ইরান। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে দেশটির হার্জলিয়া শহরের একটি ‘স্পর্শকাতর’ স্থানে হামলার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম।
গতকাল ইরানের যে সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করা হয়েছে, তাঁর নাম আলী সাদমানি। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) খাতাম আল-আনিবিয়া শাখার প্রধান। সাদমানি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ বলে জানিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী।
এ নিয়ে পাঁচ দিনে ইরানের সেনাপ্রধান ও আইআরজিসির প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। ইরানের কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকেও হত্যা করা হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা। দেশটির আরও ১০টি পারমাণবিক লক্ষ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ।
ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাগুলোতেও। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা ইরানের তিন ভাগের এক ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। এর পাশাপাশি ইরানের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়, গ্যাসক্ষেত্র, জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, বিমানবন্দর ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলা হয়েছে ইরানের বেসরকারি স্থাপনাতে। ইসরায়েলি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাই বেসামরিক নাগরিক।
একের পর এক বিস্ফোরণ
গতকাল সারা দিন ও রাতে ইরানের রাজধানী তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রাতে হামলা হয় ইস্পাহান প্রদেশেও। আগের দিন সোমবার মধ্যরাতে তেহরানের পূর্বাঞ্চলে বিস্ফোরণের পর ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এ সময় শহরটি থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনায় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সোমবার ভোরে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে সে সময় পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২২৪ জন নিহত হন। তবে গতকাল ইরানের কাশান শহরে আরও তিনজন নিহত ও চারজন আহত হন বলে জানায় দেশটির সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ। এ ছাড়া ইরানের লোরেস্তান প্রদেশে ২১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন খোররামাবাদ শহরের মেয়র রেজা সেপাহবান্দ।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আইআরআইবির ভবনে সোমবার রাতে হামলার পর সেখানেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ওই ভবনে থাকা আইআরআইবির তিনজন কর্মী নিহত হয়েছেন। ক্রমেই হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ছুটিতে থাকা সব চিকিৎসক ও নার্সকে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরতে বলেছেন ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সায়েদ সাজ্জাদ রাজাভি।
এরই মধ্যে গতকাল রাতে ইরানের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় তারা ‘শত্রুপক্ষের ২৮টি আকাশযান’ ধ্বংস করেছে। সেগুলোর মধ্যে একটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী ড্রোনও রয়েছে। এর আগের ইসরায়েলের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছিল তেহরান।
পাঁচ দিন ধরে চলা তেহরানে হামলায় শহরটির বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। শহরটিতে ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে সাধারণ লোকজনকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এরই মধ্যে আবার সোমবার তেহরানের বাসিন্দাদের শহরটি ছাড়তে বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন পরিস্থিতিতে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে। তেহরানের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, তিনি তেহরান ছেড়ে যাচ্ছেন। শহরটি এখন ফাঁকা লাগছে। শুধু যাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁরাই রয়ে গেছেন।
তেল আবিব–জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত
ইরান গতকাল ও আগের দিন রাতে ইসরায়েলের চারটি স্থানে হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট। সোমবার রাতভর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে বাজছিল সাইরেন। তেল আবিব, জেরুজালেম ও হার্জলিয়া শহরে আঘাত হানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। এ সময় একাধিকবার আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান হাজার হাজার ইসরায়েলি।
গতকাল হার্জলিয়া শহরে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সামনে আসে। এদিন এ শহরেই ‘স্পর্শকাতর’ স্থাপনায় হামলার খবর জানিয়েছিল ইসরায়েল। হামলায় হার্জলিয়ার আটতলা একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আগুন ধরে যায় একটি বাসে। গতকাল রাতেও তেল আবিবে হামলা হয় বলে জানিয়েছে ইসরায়েল বাহিনী। তাদের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন ২৪ জন।
আল-জাজিরার খবর অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৪ হাজার আবেদন পড়েছে। ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এ আবেদন করেছেন। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে ইরানের হামলায় ইসরায়েলে জ্বালানি তেল পরিশোধনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায়ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।