ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেমে যায়নি, থামেনি পারমাণবিক বোমার আশঙ্কাও
প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৫, ১২:৫৪

মাত্র কয়েক দিনের যুদ্ধে ইসরাইল ইরানের এক ডজনেরও বেশি শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, দেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক নেতৃত্বের অনেক অংশ ধ্বংস করেছে এবং পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আঘাত হেনেছে।
এটি ইসরাইলি সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তির একটি শক্তিশালী প্রদর্শন। কিন্তু তাতেও ইরানের বিস্তৃত ও নিরাপদভাবে ছড়িয়ে থাকা পারমাণবিক কর্মসূচি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি— এমনটাই বলছেন ইসরাইলি সামরিক কমান্ডার এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ বিশেষজ্ঞরা।
বরং, অনেকের আশঙ্কা— এই সহিংসতা যদি ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস না করে শেষ হয়, অথবা যদি একটি কঠোর পরিদর্শন ব্যবস্থা এবং অবাধ নিয়ন্ত্রণসহ কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে ইরান হয়তো বোমা তৈরির পথেই আরও দ্রুত অগ্রসর হবে।
একজন ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, এই আঘাত ইরানের ‘ব্রেকআউট’— অর্থাৎ একটি কার্যকর পারমাণবিক বোমা তৈরির সময়সীমা কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে।
তবে, মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করেন, ইরান এখনও তিন বছর দূরে বোমা ডেলিভারির সক্ষমতা অর্জনের। তারা বিশ্বাস করেন, ইরান এখনই সক্রিয়ভাবে বোমা তৈরির চেষ্টায় নেই— সিএনএন মঙ্গলবার জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে এই কয়েক মাসের বিলম্ব বড় কিছু নয়।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল বলেই তিনি এই হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাও যদি সত্যি হয়, এই হামলাগুলো খুব বেশি সময় কেড়ে নেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইসরাইলের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করা সম্ভব নয়।
এই হামলার সবচেয়ে বড় ফলাফল— ইরানি নেতৃত্বের মনে আতঙ্ক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ। যারা নিজের দেশের সরকারকে ঘৃণা করে, তারাও ঘুমন্ত অবস্থায় শিশুদের ঘরে ঢুকে পড়া ক্ষেপণাস্ত্রের বিভীষিকা ভুলতে পারেনি।
পুরো এলাকা খালি করে দেওয়ার আদেশ গাজা যুদ্ধের বিভীষিকাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
ইসরাইল নিজে কখনও প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, তার একটি গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে— যা প্রতিরোধমূলক হিসেবে তৈরি। অনেক ইরানিই মনে করেন, তাদেরও একই অস্ত্র থাকা দরকার। এই যুদ্ধ হয়তো সেই জনসমর্থন আরও বাড়িয়েছে।
গত এক বছরে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বকারী বাহিনীগুলো একের পর এক পতনের পর, দেশটির অভ্যন্তরে পারমাণবিক কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা বেড়েছে— বলেন সিমা শাইন। তিনি মোসাদের গবেষণা শাখার সাবেক প্রধান।
তিনি বলেন, গত দেড় বছরে আমি যতটা পারমাণবিক সামরিক সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা দেখেছি, এমনটা আগে কখনও দেখিনি। যদিও বেশিরভাগ আলোচনা ছিল— ‘ইরান বোমা বানাবে কি না’ নিয়ে, ‘বানাতে পারে কি না’ নিয়ে নয়— তবুও এই সিদ্ধান্ত বদলানো খুবই সহজ।
তিনি আরও বলেন, যদি যুদ্ধ পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস না করেই শেষ হয় এবং ইরান ‘ব্রেকআউট’ করতে পারে, তাহলে তারা তা করবেই।
এ অঞ্চল নিয়ে অভিজ্ঞ এক পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তাও একমত— ইসরাইলের হামলাগুলো যতটা না প্রতিরোধমূলক, তার চেয়েও বেশি হতে পারে পারমাণবিক বিস্তার ত্বরান্বিতকারী হিসেবে। ‘আমার মতে, যদি এই হামলার পর তাদের সক্ষমতা অক্ষত থাকে, তাহলে তারা যত দ্রুত সম্ভব বোমা বানাবে।’
ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংসে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ফোর্দো স্থাপনাটি। এটি ক্বোম শহরের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গভীরে স্থাপিত।
ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমাগুলোরও সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এখানেই সংরক্ষিত রয়েছে ইরানের অধিক সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও সেন্ট্রিফিউজ। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাংকার-ধ্বংসকারী বোমাগুলোই হয়তো এটি ধ্বংস করতে পারে।
প্রাথমিক হামলার সাফল্যে যখন ইসরাইল উল্লসিত, তখন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তজাচি হানেগবি সতর্ক করেছেন, ইসরাইল একা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারবে না। তিনি ইসরাইলি গণমাধ্যমকে বলেন, এটি কেবল সামরিক উপায়ে করা সম্ভব নয়।
বরং, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দীর্ঘমেয়াদী একটি চুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতেই সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখতে পারে। নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি কূটনৈতিক সমাধানের চেয়ে মার্কিন সামরিক সহযোগিতা বেশি পছন্দ করেন।
ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার জন্য চাপ দিয়ে বলেছেন, আমি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বুঝি, কিন্তু ‘আমেরিকা মৃত’ বুঝি না”— এ কথা তিনি বলেন এবিসি-টিভির এক সাক্ষাৎকারে।
ইসরাইলি নেতার স্বপ্ন কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস নয়, বরং তেহরানে সরকার পরিবর্তনও। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র যেটি সাধারণ মানুষের ঘরে আঘাত হানে, তা ইরানি জনগণের কাছে নেতানিয়াহুর আহ্বানকে আরও শূন্য করে তোলে।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ভালি নাসর বলেন, আমরা গাজা যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবকে অবমূল্যায়ন করছি— যারা ইরান সরকারকে ঘৃণা করে, তাদের মধ্যেও।
তিনি আরও বলেন, গাজার সরকারও এক নির্মম কর্তৃত্ববাদী শাসন, যার বিরুদ্ধে হামলার যৌক্তিকতা দেখানো হয়। কিন্তু ইসরাইল যেভাবে বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে, তা সন্ত্রাস।
ইসরাইলি সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট এই ধরনের অভিযানে যুদ্ধাপরাধের উপাদান দেখেছেন।
পশ্চিমাদের মৌন সমর্থন এই হামলাগুলোকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। নাসর বলেন, একসময় বিশ্বাস ছিল— আন্তর্জাতিক উদার গণতান্ত্রিক বিশ্ব শৃঙ্খলা ইসরাইলকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, ইউরোপ ও আমেরিকা ইসরাইলকে বেপরোয়া হতে দেবে না। গাজার ধ্বংসস্তূপে সেই বিশ্বাস ভেঙে গেছে।
যদি ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে না টানেন, এবং ইরান যদি তাড়াতাড়ি একটি পরমাণু নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে না আসে, তাহলে ইসরাইল ফোর্দো’তে আরও বড় হামলার চিন্তা করতে পারে।
আইডিএফ-এর গোয়েন্দা গবেষণা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক আলেক্স গ্রিনবার্গ বলেন, ইসরাইল ও বিশ্ব অনেক দিন ধরেই পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা মারার চিন্তা করছে।
এমনকি ফোর্দোকে বোমায় ধ্বংস করা না গেলেও, বিকল্প পদ্ধতিও রয়েছে। ইসরাইল যেহেতু ইরানের পারমাণবিক আর্কাইভের একটি বড় অংশ দখল করেছে, তারা ফোর্দোর ভিতরের অনেক পরিকল্পনা জানে।
ফলে হয়তো তাদের জন্য ভবন ব্যবস্থাপনা ভেঙে দেওয়া, প্রবেশপথ বন্ধ করা, এমনকি স্পেশাল ফোর্স দিয়ে স্থল অভিযান করাও সম্ভব।
ইতিমধ্যে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহে আঘাত হানে ইসরাইল, যার ফলে সেন্ট্রিফিউজগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। গত বছরও ইসরাইল স্পেশাল ফোর্স দিয়ে সিরিয়ার এক ভূগর্ভস্থ হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ধ্বংস করেছে।
নেতানিয়াহু যতই সামরিক হামলা চান না কেন, আন্তর্জাতিক পরমাণু নিরাপত্তা সংস্থার প্রেসিডেন্ট ডেভিড আলব্রাইট বলেন, একটি কঠোর পরিদর্শনভিত্তিক চুক্তিই হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে সবচেয়ে কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, ইসরাইলের কৌশলের সমস্যা হলো— যদি তারা বোমা মারা বন্ধ করে, তাহলে ইরান আবার সবকিছু গড়ে তুলতে পারে। তখন আবার নতুন করে বোমা ফেলতে হবে।
(অনলাইন গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ)