ইরান-ইসরায়েল সংঘাত
ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা
প্রকাশ | ২১ জুন ২০২৫, ০৩:১০

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলার মাঝেই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জেনেভায় বৈঠক করেছেন ইউরোপীয় দেশগুলোর কয়েকজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল বৈঠক শেষে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি জানিয়েছেন, ইরান, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে তারা সবাই চলমান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এদিকে গতকাল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তেহরান, তাবরিজ ও কেরমানশাহ শহরে ইরানি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে তেহরানও ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এতে দক্ষিণ ইসরায়েলের একটি টেক পার্কে অফিস ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ইরানি হামলায় ২০ জনের বেশি আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো।
এদিকে ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যেই ইরানে আঘাত হেনেছে ভূমিকম্প। গতকাল সন্ধ্যায় ইরানের কোম শহরের কাছে ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, সোরখেহ শহরের কাছাকাছি, সেমনান প্রদেশে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি।
আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত: জেনেভায় গতকাল অনুষ্ঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যেখানে তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে আলোচনার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি সাংবাদিকদের বলেন, এটি এক বিপজ্জনক মুহূর্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এ সংঘাত যাতে আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। তিনি আরো বলেন, ‘ইউরোপীয় নেতারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ইরান কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে না।’
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল ব্যারো বলেছেন, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দেশটির পরমাণু কর্মসূচি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনায় এগিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করি, ইরান আলোচনায় উন্মুক্ত থাকবে, যাতে এ সংকটময় পরিস্থিতি সমাধানে সংলাপের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো যায়।’ তিনি বলেন, ‘এ সংকট শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইউরোপের জন্যও গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে আলোচনার পর ইউরোপীয় নেতারা এ বৈঠকে বসেন। রুবিও ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় প্রস্তুত, যদিও তারা একই সঙ্গে ইসরায়েলি হামলায় অংশ নেয়ার সম্ভাবনাও বিবেচনা করছেন। সিএনএন এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয়দের কূটনৈতিক প্রয়াসকে সমর্থন করেছেন। কূটনীতিকদের মতে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে শিগগির কোনো যুদ্ধবিরতি আসবে না বলেই তারা মনে করছেন। তাই তারা প্রাথমিকভাবে ইরানের সঙ্গে একটি সমান্তরাল আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করার চিন্তা করছেন, যেখানে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় কঠোর পরিদর্শনসহ একটি নতুন পরমাণু চুক্তির কাঠামো তৈরি হবে। এতে ইরানকে কিছু সীমিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির সুযোগ রাখা হতে পারে, যদিও ট্রাম্প প্রশাসন সম্পূর্ণ সমৃদ্ধি বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
হামলা-পাল্টাহামলা অব্যাহত: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি হামলার উত্তাপ শুক্রবার নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েল নতুন করে দক্ষিণাঞ্চলীয় বুশেহর শহরে হামলা শুরু করেছে। সেখানে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অবকাঠামোয় হামলা চালাচ্ছে।
পাল্টা জবাবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের হাইফা শহরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, শহরটিতে বিস্ফোরণের দৃশ্য। সর্বশেষ এ হামলায় ২০ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের জরুরি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাগেন ডেভিড অ্যাডম। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর, যাদের মধ্যে একজন ১৬ বছর বয়সী কিশোর ও অন্যজন ১৪ বছর বয়সী। একাধিক অ্যাম্বুলেন্স ও হাসপাতালের মাধ্যমে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) জানিয়েছে, তারা সর্বশেষ দফার হামলায় ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এসব স্থাপনার মধ্যে নেভাতিম ও হাতজেরিম ঘাঁটিও রয়েছে। এক বিবৃতির বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানায়, আইআরজিসি বলছে তেল আবিব, হাইফা ও বিরসেবায় নির্ভুল আঘাত প্রমাণ করে যে আমাদের আক্রমণাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরায়েলের নিঃশর্ত আগ্রাসন বন্ধই সংঘাতের একমাত্র সমাধান। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘এ আগ্রাসন বন্ধ না হলে ইরান এমন জবাব দেবে, যা আগ্রাসনকারীকে অনুতপ্ত করবে।’
এদিকে ইরানের রাজধানী তেহরানে একটি হাসপাতালের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলার অভিযোগ করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে সাতদিনের মাথায় তৃতীয় কোনো হাসপাতাল ইসরায়েলি হামলার শিকার হলো বলে জানানো হয়। এতে ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য কেন্দ্র ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি তেহরানের।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ নতুন করে সরকারি প্রতীক ও ক্ষমতার কেন্দ্রে হামলা জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানের শাসন ব্যবস্থার প্রতীক, বাসিজ মিলিশিয়া ও রেভল্যুশনারি গার্ডকে লক্ষ্য করে হামলা চালাব।’ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ বক্তব্য ইসরায়েলের যুদ্ধনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে—যেখানে ইরান সরকারের অস্থিতিশীলতাকে এখন মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরা হচ্ছে।
যুদ্ধ বন্ধ ও আলোচনায় ফেরার আহ্বান গুতেরেসের: জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে অব্যাহত সংঘাতের ফলে বিশ্ব একটি সংকটের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ সংঘাতের বিস্তার হলে যে আগুন জ্বলবে, তা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’
গতকাল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে উদ্বোধনী বক্তব্যে গুতেরেস এসব কথা বলেন। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত নিয়ে এ বৈঠক আহ্বান করা হয়। এতে সব পক্ষকে শান্তিপূর্ণ একটি সমাধানে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে গুতেরেস বলেন, ‘আমি যুদ্ধ বন্ধের এবং আন্তরিকতাসহ আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’
জাতিসংঘ মহাসচিব আরো বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, এ সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে ‘পারমাণবিক প্রশ্ন’। তিনি বলেন, ‘ইরান বারবার বলেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র চাইছে না। কিন্তু আসুন আমরা স্বীকার করি, এখানে আস্থার অভাব রয়েছে।’