১৯৫৩ সালে ৪ দিনে ২ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইরানের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল আমেরিকা ও ব্রিটেন

প্রকাশ | ২১ জুন ২০২৫, ১২:৫০

যাযাদি ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত

 



প্রথম দেখায় হঠাৎ করে তার দিকে তাকালে মনেই হতো না যে তিনি জাতীয় নেতাগোছের কেউ একজন। তার গড়নে, তার চলনে, তার গাম্ভীর্যে যে ভাবটি বারংবার ফুটে উঠতো তাতে অনেকের কাছেই অনুমেয় হতে পারে, তিনি বোধয় একজন কবি। দেখতে রোগা আর লিকলিকে এই মানুষটি ছিলেন বেশ লম্বা। তার বাঁশির মতো নাক, সরু ঠোঁট, অকৃত্রিম আর নিষ্পলক চাহনি দেখে একবারের জন্যে হলেও যে কারও মনে হতো লোকটি ভীষণ আবেগী।
নিজের আদর্শ আর বিশ্বাসের জায়গাগুলো নিয়ে কেউ আঘাত করলে শিশুদের মতোই কেঁদে ফেলতেন তিনি। কথা বলতে বলতে ধরে আসতো তার গলা।
এই লোকটির একটি ছবি দিয়ে ১৯৫২ সালের ৭ জানুয়ারি বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ করেছিল। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা ছিল- 'বিশৃঙ্খলার তেলের চাকা ঘোরান তিনি'। ওই আর্টিকেলের ভেতর তার পরিচয়ে লেখা হয়- 'নতুন হুমকি'।
এভাবেই ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এবং অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের সাহসী বীর মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করায় পশ্চিমারা। আরও স্পষ্ট করে বললে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
মোসাদ্দেগের অপরাধ ছিলো, দখলদারদের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি নিজ দেশ ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিলো, ইরানের ভূমি থেকে উত্তোলন করা তেলের মালিক ইরানেরই জনগণ। অ্যাঙলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি নামে ব্রিটিশ মালিকানাধীন একটি কোম্পানি সেসময় ইরানে বসেই পুরো দেশের তেল বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করতো। বিষয়টি ভীষণ পীড়া দিতো মোসাদ্দেগকে।
১৮৮২ সালে মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের জন্ম হয়েছিল তৎকালীন পারস্যের নামকরা এক পরিবারে। তেহরান স্কুল অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের আইনের অধ্যাপক মোসাদ্দেগ বরাবরই ছিলেন গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের পক্ষে। পারিবারিকসূত্রে অল্প বয়স থেকেই ইরানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার। ১৯১৭ সালে তিনি হন ইরানের উপ-অর্থমন্ত্রী, ১৯২১ সালে হন অর্থমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে হন প্রভাবশালী মজলিস সদস্য।
সম্পর্কে ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রেজা খানের বন্ধু ছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রেজা যখন ইরানের শাহ হওয়ার ইচ্ছেপোষণ করেন তখন এর বিরোধিতা করেছিলেন মোসাদ্দেগ। মোসাদ্দেগ বলেছিলেন, এটি হবে ইরানের ১৯০৬ সালে তৈরি করা সংবিধানের লঙ্ঘন। এ ঘটনায় স্বৈরশাসক রেজা ক্ষুব্ধ হন তার ওপর। শাহ এর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণ করা মোসাদ্দেগ হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনীতি থেকে বিদায় নেন।
 ১৯৪১ সালে রেজা খানের ছেলে মোহাম্মদ রেজা পাহালভী ইরানের পরবর্তী শাহ হলে ফের রাজনীতিতে যোগ দেন মোসাদ্দেগ। রাজনীতির মাঠে এসেই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অ্যাঙলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারণায় নামেন তিনি।
নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একটা সময় তিনি ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী হয়েই দেশের তেলসম্পদকে জাতীয়করণ করতে একটি বিল পাস করিয়ে নেন তিনি।  নয়া প্রধানমন্ত্রীর এমন পদক্ষেপের পর ব্রিটিশরা বহুবার মোসাদ্দেগকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও নিজ দেশের এই সম্পদ রক্ষায় কোনোপ্রকার ছাড় দিতে রাজি হননি তিনি। উপায়ান্তর না দেখে ব্রিটিশরা দ্বারস্থ হয় তাদের সবসময়ের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা বুঝতে পারে, মোসাদ্দেগের প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সেকারণে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা যুগপৎভাবে মোদাদ্দেককে গদিচ্যুত করতে পরিকল্পনা শুরু করে। ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনার ছক আঁকে তারা।