ট্রাম্প ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে মিত্রহীন ইরান একাই লড়ছে

প্রকাশ | ২৩ জুন ২০২৫, ১৮:৩৬ | আপডেট: ২৩ জুন ২০২৫, ১৯:৫৮

যাযাদি ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সাম্প্রতিক হামলার পর তেহরান যখন চরম প্রতিকূলতার মুখে, তখন রাশিয়া ও চীন কেবল মুখেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, তেহরানের প্রক্সি যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী যেমন, হিজবুল্লাহ, হুথি কিংবা সিরিয়াভিত্তিক মিলিশিয়ারা, কেউই এখন সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না, বা পারে না।

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে 'প্রক্সি যুদ্ধের' কুশলী হিসেবে শক্তি প্রদর্শন করে আসা ইরান এখন সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে। তবে এবার আর পুরনো মিত্রদের পাশে পাচ্ছে না তেহরান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সাম্প্রতিক হামলার পর তেহরান যখন চরম প্রতিকূলতার মুখে, তখন রাশিয়া ও চীন কেবল মুখেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তেহরানের প্রক্সি যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী যেমন, হিজবুল্লাহ, হুথি কিংবা সিরিয়াভিত্তিক মিলিশিয়ারা, কেউই এখন সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না, বা পারে না।

৭ই অক্টোবরে হামাসের আকস্মিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনীতিকে নতুন করে নাড়িয়ে দেয়। এ হামলা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহু বছরের চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলেও, তা পরিণত হয়েছে একটি বহু-মাত্রিক যুদ্ধপরিস্থিতিতে। এই প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসা ট্রাম্প সরাসরি ইরানের উপর আগ্রাসী হামলা চালিয়ে এক প্রকার 'রেড লাইন' অতিক্রম করেছেন, যা পূর্ববর্তী কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট করেননি।

১৩ জুন ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরুর পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুধু তেহরানের পারমাণবিক কার্যক্রম থামানো নয়, বরং ইরানে 'শাসন পরিবর্তনের' ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তবে মিত্রশূন্য ও একঘরে হয়ে পড়া ইরান এখন যে কোনো প্রতিক্রিয়ায় আরও 'অনিশ্চিত' হয়ে উঠতে পারে।

ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স-এর বিশ্লেষক অ্যাডাম ফারার ও দিনা এসফানদিয়ারির মতে, 'ইরান তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পরীক্ষার মুখে পড়লেও রাশিয়া বা চীন থেকে কার্যত কোনো সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশ দুটি তেহরানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদার হলেও তারা কোনো সামরিক জোটে নেই এবং বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে তারা তেহরানকে সরাসরি সহায়তা করতে রাজি নয়।'

অন্যদিকে পশ্চিমা আধিপত্যবিরোধী 'নিউ গ্লোবাল অর্ডার'-এর কথা বললেও ব্রিকস জোট এই সঙ্কটে কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। ইরান ২০২৪ সালের শুরুতে এই জোটের সদস্যপদ লাভ করে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এ জোট ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলা নিয়ে নীরব।

চলমান যুদ্ধের আগেই জানুয়ারিতে রাশিয়ার সঙ্গে একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরান। রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে তেহরান ড্রোন সরবরাহ করেছিল, তবে মস্কো এখন পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, ওই চুক্তিতে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা বাধ্যবাধকতা নেই এবং তারা ইরানকে অস্ত্র দেবে না। যদিও রাশিয়া দাবি করছে, ইরান তাদের কাছে এখনো অস্ত্র চায়নি।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি রোববার তুরস্কে সাংবাদিকদের জানান, তিনি সোমবার মস্কো যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার জন্য। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেখানেও তিনি উষ্ণ কথাবার্তা ছাড়া তেমন কিছু পাবেন না।

২০১৫ সালে যখন সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রাখতে ইরান ও রাশিয়া একসঙ্গে সেনা পাঠিয়েছিল, তখনকার তুলনায় এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিদ্রোহীদের হাতে আসাদ সরকার শেষ পর্যন্ত পতিত হয়েছে, আর পুতিন বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে নিজেই চাপের মুখে।

চীনও এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে 'দৃঢ়ভাবে' নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু তারা ইরানকে কোনো ধরনের সহায়তা দেয়নি, যদিও দেশটি তার ৯০ শতাংশ তেল রফতানিই করে চীনে।

ইরানের প্রতিবেশী উপসাগরীয় দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যে তেহরান যদি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে তা ভয়াবহ আঞ্চলিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে।

এ অঞ্চলের দেশগুলো গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পরমাণু আলোচনায় মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু এখন সামরিক সক্ষমতাই সব আলোচনাকে ছাপিয়ে গেছে।

এক সময় যেসব মিত্র ও সহায়তার ওপর ভর করে ইরান পুরো অঞ্চলজুড়ে তার প্রভাব বিস্তার করত, এখন সেই বন্ধনগুলো আর সক্রিয় নেই। ফলে ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর 'নতুন যুদ্ধনীতি'র মুখে ইরান কূটনৈতিকভাবেও একপ্রকার একাকী হয়ে পড়েছে। এতে করে যে কেবল ইরানের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়েছে তা নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি অস্থির ও অনিশ্চিত সময়ে প্রবেশ করছে।

ইরানের 'প্রতিরোধ অক্ষ' জোটের দীর্ঘদিনের প্রধান শক্তি হিজবুল্লাহ, হামাসের মতোই ইসরায়েলি বাহিনীর প্রবল আঘাতে এখন কোণঠাসা। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সামরিক বাহিনীর ওপর ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলাও অবশেষে তার সরকারের পতনের এক অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে ইরানের প্রক্সি যোদ্ধারা কার্যত অদৃশ্য। হিজবুল্লাহ এখনো একটি বিপজ্জনক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও, ২০২৩ সালে হামাসের হামলার পর যেমন ইসরায়েলের দিকে রকেট ছুড়ে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এবার আর সে পদক্ষেপ নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যদিও রোববার লেবানন থেকে তাদের দূতাবাসের সদস্য ও কম গুরত্বপূর্ণ কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, হিজবুল্লাহর আচরণ থেকে এখনো সরাসরি সংঘাতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা একমাত্র ব্যতিক্রম। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা মার্কিন বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজের বিরুদ্ধে নতুন হুমকি দেয়। কিন্তু এমন হুমকি দিয়ে তারা নিজেরাই মার্কিন হামলার মুখোমুখি হতে পারে।

এদিকে ইউরোপের অবস্থান এখন প্রায় গুরুত্বহীন। তারা শুধু ইরান নয়, ট্রাম্প বা নেতানিয়াহুকেও আর প্রভাবিত করতে পারছে না। ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। কারণ, একদিকে ইউরোপের প্রধান অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব, অন্যদিকে উপনিবেশবাদী অতীতের দায় এবং ইসরায়েলের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত।

বিশেষ করে জার্মানির নাৎসি অতীতের প্রেক্ষিতে দেশটিতে ইসরায়েলপন্থী অবস্থান বরাবরই জোরালো। তবে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে ফিলিস্তিনপন্থী জনমত তাদের সরকারি অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে।

বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ক্ষমতায় থাকা লেবার পার্টির ভাবমূর্তি এখনো টনি ব্লেয়ারের ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণে যোগদানের সিদ্ধান্তের জন্য কলঙ্কিত। প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এই ইতিহাস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে  বেশ সচেষ্ট। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক অভিযানে সমর্থন দেওয়ার তার পক্ষে কোনো লাভ নেই। ট্রাম্প নিজেও এ সহযোগিতা চাননি এবং যুক্তরাজ্যও খুশিমনে বাইরে থেকে দেখেছে, যদিও পরিস্থিতি বদলালে ব্রিটেন কিছুটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত।

এই বাস্তবতায় ইউরোপ এখন একপ্রকার দর্শকের ভূমিকায়। ইউরোপ এখন নিজস্ব অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত ইউরোপ চায় ট্রাম্প অন্তত ন্যাটোর হেগ সম্মেলনে সংক্ষিপ্ত উপস্থিত থাকুক।

ইউরোপ অতীতে ইরানের সঙ্গে গোপন কূটনৈতিক পথ খুলে দিয়েছিল। কিন্তু এখন যেহেতু ওয়াশিংটন ও ইউরোপ একসঙ্গে কাজ করছে না, ফলে অনেক কূটনৈতিক সংকেত আর পৌঁছাচ্ছে না তেহরানে।

মধ্যপ্রাচ্যে যখন এক গভীর ও বিস্তৃত সংকট ঘনিয়ে আসছে, তখন মার্কিন একক উদ্যোগ এবং ইউরোপের প্রান্তিক ভূমিকা বিশ্ব কূটনীতির একটি নতুন বাস্তবতা সামনে আনছে; যেখানে একসময়কার 'চিরচেনা জোট' এখন দৃশ্যপট থেকে মুছে যাচ্ছে।