যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের উত্থান-পতন
প্রকাশ | ২৪ জুন ২০২৫, ১৫:৩৪ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ১৫:৪৫

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার দিনই সোমবার রাতভর তেহরানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। যুদ্ধ কি তবে আসলেই থামবে, নাকি ফিরে আসতে চলছে নতুন রূপে—এই প্রশ্নই গত কয়েকদিন ঘুরপাক খাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে।
মূলত গেল রোববার, পরিস্থিতি মোড় নেয় এক নাটকীয় বাঁকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি নির্দেশ দেন ইরানের ওপর মার্কিন হামলার। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো 'সম্পূর্ণ ধ্বংস' হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এটি ছিল 'উচ্চপর্যায়ের গোপন সামরিক অভিযান', যাতে অংশ নেয় ১২৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান এবং ব্যবহার করা হয় ৭৫টি প্রিসিশন বোমা (নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম বোমা)।
এই হামলা শুধু ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধকেই আরেক ধাপ উসকে দেয়নি, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনাকেও ঠেলে দেয় কয়েক দশকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে ইরান। খোমেনির নেতৃত্বে পাহলভি শাসনের পতনের পর থেকে ওয়াশিংটন ও তেহরানের সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। আঞ্চলিক সংঘাতে একে অপরের মিত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা—দুই দেশের বিবাদের ইতিকথা দীর্ঘ।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের চোখেও ইরান সবসময় ছিল এক অস্তিত্বগত হুমকি। গেল সপ্তাহে তেলআবিব নজিরবিহীন হামলা চালায় ইরানজুড়ে, অভিযোগ তোলে—তেহরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। যদিও এই দাবির পক্ষে দৃঢ় প্রমাণ মেলেনি, তবে ট্রাম্প প্রশাসন তাতে সায় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি এই সংঘাতে জড়িয়ে ফেলে।
ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এই হামলার 'প্রতিশোধ' অবশ্যই নেওয়া হবে।
যুদ্ধবিরতি আপাতত একটি সাময়িক বিরতি হয়তো এনে দেবে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে পরাশক্তিগুলো মুখোমুখি হয়ে পড়েছে—তা কি সত্যিই কোনো স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা তৈরি করছে? নাকি এই যুদ্ধবিরতি শুধুই পরবর্তী সংঘর্ষের প্রস্তুতি?
বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা থেকে তীব্র বৈরিতা, পারমাণবিক চুক্তি থেকে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা—গত সাত দশকে বহু রূপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ১৯৫৩ সালে ইরানে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার পতনের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কের নাটকীয় সূচনা, তা কখনো পৌঁছেছে বন্ধুত্বের শীর্ষে, আবার কখনো নেমে গেছে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
নিচে এক নজরে তুলে ধরা হলো যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের প্রধান কিছু মোড় ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সময়রেখা:
১৯৫৩ | যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত অভ্যুত্থান ও শাহের পুনর্বহাল :
যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের উত্তেজনার সূচনা ঘটে ১৯৫৩ সালে, যখন ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেল জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। ১৯৫১ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) জাতীয়করণ করেন। এতে ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায়। এরপর যুক্তরাজ্যের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) এক গোপন অভিযানে অংশ নিয়ে অভ্যুত্থানে সহায়তা করে এবং পূর্বে অপসারিত রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানো হয়।
১৯৫৭ | 'অ্যাটমস ফর পিস' ও পারমাণবিক সহায়তা:
ইরানে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে শাহকে সমর্থন জানায় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্ররা। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুওয়াইট আইজেনআওয়ারের 'অ্যাটমস ফর পিস' কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এক দশক পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে একটি পারমাণবিক চুল্লি ও তাতে ব্যবহারের জন্য ইউরেনিয়াম সরবরাহ করে। তখনকার এই পারমাণবিক সহযোগিতাই পরবর্তী সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বর্তমান উত্তেজনার ভিত্তি গড়ে তোলে।
১৯৭৯ | ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্ম:
শাহ আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও, ইরানে স্বৈরশাসন ও পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ জমতে থাকে। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে দেশে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন। একপর্যায়ে জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শাহ। এরপর নির্বাসনে থাকা ইসলামি চিন্তাবিদ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে এসে নেতৃত্ব দেন নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে।
১৯৮০ | ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ:
শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় ইরানী ছাত্রসমাজ। তারা ৫২ জন মার্কিন নাগরিককে জিম্মি করে রাখে ৪৪৪ দিন। এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় শাহের মৃত্যু হয়।
১৯৮০–৮৮ | ইরান-ইরাক যুদ্ধ: ইরাককে সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের :
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইসলামি বিপ্লবের আদর্শকে প্রতিহত করতে ইরানে হামলা চালালে দুই দেশের মাঝে দীর্ঘ আট বছর ধরে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ও গোপনে ইরাকের পক্ষে অবস্থান নেয়, যা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ককে আরও তলানিতে পৌঁছে দেয়। যুদ্ধের সময় উভয় পক্ষের হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। ইরাক এই যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে।
১৯৮৪ | সন্ত্রাসে মদদদাতা রাষ্ট্রের তালিকায় ইরান:
লেবাননে একাধিক হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ইরানকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'সন্ত্রাসে মদদদাতা রাষ্ট্র' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন। ওই সময় লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলের সাথে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়ে। বেইরুতের এক সামরিক ঘাঁটিতে হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার জন্য ইরান-সমর্থিত লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে দায়ী করে।
তবে পরে রেগান প্রশাসন হিজবুল্লাহর হাতে আটক মার্কিন জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে ইরানের সঙ্গে এক গোপন আলোচনা চালায়। এটি 'ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি' নামে পরিচিত এবং তা রেগানের জন্য বড় এক রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
১৯৮৮ | ইরান এয়ার ফ্লাইট গুলি করে ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র :
ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালে পারস্য উপসাগরে দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। সে বছর ৮ জুলাই একটি মার্কিন নৌজাহাজ ইরানি জলসীমা লঙ্ঘন করে এবং দুবাইগামী ইরান এয়ার ফ্লাইট ৬৫৫-এ গুলি চালায়। এতে বিমানে থাকা ২৯০ জন যাত্রী ও ক্রু সবাই নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এটি একটি 'ভুল বোঝাবুঝি' ছিল। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার বা ক্ষমা না চাইলেও নিহতদের পরিবারকে ৬১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়।
১৯৯৫ | নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করে যুক্তরাষ্ট্র:
১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ইরানের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের নির্বাহী আদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলোর ইরানের সঙ্গে ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি কংগ্রেস এমন একটি আইন পাস করে, যা ইরানের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং তেহরানে উন্নত অস্ত্র বিক্রেতাদের শাস্তির মুখে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র এসব পদক্ষেপের পেছনে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অগ্রগতি ও হিজবুল্লাহ, হামাস এবং প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদের মতো গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের অভিযোগ তোলে।
২০০২ | ৯/১১-পরবর্তী পরিস্থিতি :
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ 'স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন' ভাষণে ইরানকে ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একত্রে 'অ্যাক্সিস অব ইভিল' বা 'অশুভ জোট' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অথচ ওই সময় আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পর্দার আড়ালে যোগাযোগে ছিল ইরান।
এই সহযোগিতা ধাক্কা খায় বুশের বক্তব্যের পর। এরই মাঝে ২০০২ সালের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ইরানে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করেন, যা তেহরানের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞার পথ খুলে দেয়।
২০২০ | কাসেম সোলাইমানি হত্যা ও পাল্টা হামলা :
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এক ড্রোন হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) এলিট কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে বাগদাদে হত্যা করে। এর এক বছর আগে ট্রাম্প প্রশাসন কুদস ফোর্সকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। জেনারেল সোলাইমানির হত্যার জবাবে ইরান ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
২০২৫ | তেহরানের উদ্দেশ্যে চিঠি যুক্তরাষ্ট্রের :
২০২৫ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে নতুন পারমাণবিক চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং ৬০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। তবে খামেনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে আলোচনায় নয়, বরং চাপ সৃষ্টি করতে চায়।
এরপর ওমান ও ইতালিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয়, যেখানে ওমান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। একাধিক রাউন্ড আলোচনার পর ট্রাম্প দাবি করেন, তার দল একটি চুক্তির 'অত্যন্ত কাছাকাছি' এবং একইসঙ্গে ইসরায়েলকে ইরানে হামলা না চালানোর হুঁশিয়ারি দেন। তেহরানও এতে আশাবাদ প্রকাশ করে, তবে ইআলোচনার মূল বিতর্কের বিষয়—ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অধিকার নিয়ে তারা অটল থাকে।
ষষ্ঠ আলোচনার ঠিক আগের দিন ইসরায়েল ইরানজুড়ে হামলা চালায়।
২০২৫ | যুক্তরাষ্ট্রের হামলা:
নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ এবং ইসরায়েলের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। তবে চলমান সংঘর্ষের অবসানে ইরান ও ইসরায়েল 'সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক' যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যদিও ইরান বা ইসরায়েল কোনো পক্ষই এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পের ঘোষণা দেওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।