ইরানের ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত কোথায় আছে জানে না কেউ; ভবিষ্যৎ নিয়ে ধোঁয়াশা

প্রকাশ | ২৭ জুন ২০২৫, ১৬:১৩

যাযাদি ডেস্ক
একটি স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পর ইরানের নাতাঞ্জ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে ভূগর্ভস্থ সেন্ট্রিফিউজ হলগুলোর ওপর বিস্ফোরণের গর্ত। ২২ জুন ,২০২৫। সূত্র : রয়টার্স

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে—ইরানের ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত কোথায় আছে।

বছরের পর বছর ধরে ইরান ভূগর্ভে পারমাণবিক স্থাপনা গড়ে তোলে এবং সেখানে সেন্ট্রিফিউজ বসিয়ে ৮৮০ পাউন্ড (প্রায় ৪০০ কেজি) ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম জমা করে, যা প্রায় বোমা তৈরির উপযোগী মাত্রা।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে থেকেই বলছিল, ইরান এখনো পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম থাকায় তারা মাত্র কয়েক ধাপ দূরেই অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলায় ইরানের পুরো পারমাণবিক কর্মসূচি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে নতুন করে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনে ইরানের সময় লাগবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের বিশ্লেষণ বলছে, ইরান যদি বুঝতে পারে যে তাদের স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা হতে পারে, তাহলে তারা হয় কূটনৈতিক আলোচনায় চাপ সৃষ্টি করতে কিংবা দ্রুত বোমা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ইউরেনিয়ামের মজুত সরিয়ে ফেলবে।

রোববার এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, যুক্তরাষ্ট্র 'ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুত নিয়ে কথা বলতে চায়'।

তবে বৃহস্পতিবার ট্রাম্প প্রশাসন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ইরান ইউরেনিয়াম সরাতে পেরেছে—এ ধারণা তারা মানে না।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ইউরেনিয়ামের মজুত ফোরদোতে বোমা হামলায় 'ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা মাটিচাপা পড়ে গেছে'। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, 'স্থাপনাটি থেকে কিছুই সরানো হয়নি। সরাতে অনেক সময় লাগত, বিপজ্জনক ছিল, আর জিনিসগুলো খুব ভারী ও সরানো কঠিন।'

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, 'আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে হামলার আগে ইউরেনিয়াম সরানো হয়েছিল।'

তবে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউরেনিয়ামের মজুত নিয়ে পাওয়া তথ্য পরস্পরবিরোধী। তাদের মতে, ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে—কে কতটা ইউরেনিয়াম কোথায় রেখেছে, সে বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা একেক রকম।

নাতাঞ্জে অবস্থিত একটি পারমাণবিক স্থাপনার কিছু অংশ, যেখানে ইউরেনিয়াম রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, তা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি—বলেন কর্মকর্তারা।

ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না, ইরান ঠিক কতটা ইউরেনিয়াম সংরক্ষণে রেখেছে।

বৃহস্পতিবার মার্কিন সিনেটে একটি গোপন ব্রিফিংয়ের পর রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম সাংবাদিকদের বলেন, 'আমি জানি না ৯০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম কোথায় আছে, তবে এটা গত কয়েক বছর ধরেই হামলার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল না। আজ তা ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু তারা আবার তা পুনর্গঠন করতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও 'আমি চাই না মানুষ ভাবুক, সমস্যা শেষ হয়ে গেছে—কারণ তা হয়নি।'

এদিকে, ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুত প্রথম কোথায় ছিল, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন, এটি ছিল ফোরদোতে। অন্যরা বলছেন, কিছু ছিল নাতাঞ্জে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, অধিকাংশ মজুত ছিল ইসফাহানে—যেখানে ইরানের রিঅ্যাক্টর ও ইউরেনিয়াম ব্যবহারকারী স্থাপনা রয়েছে।

কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ইরান মজুত ভাগ করে বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে ফেলেছে।

আইএইএ-এর মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি বলেন, ইরান তাদের পরিদর্শকদের জানিয়েছে—যদি ঝুঁকি দেখা দেয়, তারা ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলবে। তিনি জানান, সেটি এমন কন্টেইনারে রাখা ছিল, যা 'একটা সাধারণ গাড়ির বুটে' রাখাও সম্ভব ছিল।

ইসফাহানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগের দিনগুলোতে ল্যাব থেকে কিছু জিনিস আনা-নেওয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে।

আইএইএ কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তাই সেটি এক জায়গায় রেখে দেওয়াটা 'সাধারণ জ্ঞানের পরিপন্থী'।

এই সপ্তাহে আইএইএ প্রধান গ্রোসি বলেন, 'আমি জানি না তারা সব সরিয়েছে কি না। তবে প্রমাণ বলছে, অনেকটাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।'

বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, তাদের প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে, ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়েছে। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ের ধারণা এবং ইউরেনিয়ামের সঠিক অবস্থান নিশ্চিত নয়।

পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তারাও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে একমত যে, এসব স্থাপনা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

বিশেষ করে ফোরদোর সেন্ট্রিফিউজগুলো ফের চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম, ফলে ইউরেনিয়াম আরও বিশুদ্ধ করার কাজও কঠিন হয়ে পড়বে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বুধবার হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে বলেন, ইসফাহানে অবস্থিত 'কনভার্সন ফ্যাসিলিটি' ধ্বংস হওয়ায় ইরানের বোমা তৈরির সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই স্থাপনাটি মূলত গ্যাস আকারে থাকা ইউরেনিয়ামকে কঠিন পদার্থে রূপান্তর করে, যা পরে পারমাণবিক বোমা বা ওয়ারহেড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

তবে ইরানের পুরো পারমাণবিক কর্মসূচি ও নতুন জ্বালানি তৈরির সক্ষমতা পেছনে পড়লেও, তারা কত দ্রুত বোমা তৈরি করতে পারে—সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।

গত দুই সপ্তাহের সংঘাতে ইসরায়েল অনেক ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। তবে যদি পর্যাপ্তসংখ্যক বিজ্ঞানী বেঁচে থাকে, তাহলে ইরান গোপনে রাখা মজুত ব্যবহার করে দ্রুত বোমা তৈরির পথে এগিয়ে যেতে পারে।

এর মানে, বৃহত্তর কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও একটি 'ক্রুড বোমা' তৈরির সক্ষমতা হয়তো মাত্র কয়েক মাস পিছিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি জিম হাইমস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, 'স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে কিছু হবে না, যদি ইরান আগে থেকেই ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম, সেন্ট্রিফিউজ আর অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম এমন কোনো অজানা স্থানে সরিয়ে থাকে।'

তিনি আরও লেখেন, 'শাসকগোষ্ঠী হয়তো নৃশংস, কিন্তু তারা বোকা নয়। এসব জিনিস সহজেই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায়ন