৯২ বছর ধরে চলছে নওয়াব শাহী জামে মসজিদে কোরআন তেলাওয়াত

প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ২০:০৯

ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

৯২ বছর ধরে চলছে কোরআন তেলাওয়াত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ, রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক কিছুই হয়েছে এই নয় দশকে। কিন্তু থামেনি এই কোরআন তেলাওয়াত। একজন পড়ে উঠে গেল অন্যজন কোরআন নিয়ে বসছেন। নামাজের সময় ব্যতীত সারাক্ষণ চলে কোরআন তেলাওয়াত।

 

কোরআনের সেই সমধুর সুর, কবরের চারপাশে প্রতিনিয়তই ধ্বনিত হয়েছে।  কবরটি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর। ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল ৬৫ বছর বয়সে তিনি মারা গেলে নিজ বাড়ির মসজিদ চত্বরে সমাহিত করা হয় তাকে। সেই সময় থেকেই তার কবরের পাশে বসে এই তেলাওয়াত চলছে।

 

নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

 

জানা যায়, ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পৃথক দুটি মানপত্রে নবাব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সভায় তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে অর্থাভাব দেখা দিলে তিনি নিজ জমিদারির একাংশ বন্দক রেখে এককালীন ৩৫ হাজার টাকা দেন।

 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি বাবদ ১৬ হাজার টাকার একটি তহবিল নওয়াব আলী চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিনেট ভবনের নাম ‘ সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন’ নামকরণ করেন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

 

ধনবাড়ী নওয়াব জামে মসজিদের পেশ ইমাম মওলানা মুফতি ইদ্রিস হোসাইন জানান, মৃত্যুর আগেই নওয়াব আলী চৌধুরী মসজিদের কাছে তার কবরের জায়গা নির্ধারণ করেন। প্রতিদিন ৫ জন হাফেজ কোরআন তেলাওয়তের দায়িত্বে থাকেন। তারা পালাক্রমে তেলাওয়াত করেন। সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে আটটা, সাড়ে আটটা থেকে বেলা ১১টা, বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা, দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল চারটা এবং বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা। এভাবে আবার রাতের পালাও শুরু হয়। একেক শিফটে (পালা) একেকজন কোরআন পাঠের দায়িত্বে থাকেন।

 

বর্তমানে হাফেজ আব্দুস সামাদ ছাড়াও মো. কামরুজ্জামান, আবু হানিফ ও হেদায়েত হোসেন এবং মো. ওয়ারেজ আলী নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াতের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। এরা কেউ অসুস্থ হলে অথবা ছুটিতে বাড়িতে গেলে মসজিদের পাশেই হিফজখানা থেকে ছাত্রদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা হয়। তেলাওয়াতকারীরা এখানে কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি হিফজখানায় শিক্ষকতা করেন। আর সেখান থেকেই তাদের সম্মানী দেওয়া হয় বলে নওয়াব শাহী জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মৌওলানা মুফতি মো. ইদ্রিস হোসাইন জানান।

 

সরেজমিন দেখা যায়, নওয়াব আলীর কবরের পাশে একজন কোরআন তেলাওয়াত করছেন। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসছেন। মসজিদের পাশে তার কবরস্থানে চলছে অবিরাম কোরআন তেলাওয়াত।

 

ধনবাড়ী এলাকার মুক্তাদির মো. আ. সামাদ ও আছেদ আলী জানান, ধনবাড়ীর এই নওয়াব আলী চৌধুরীর কবরের পাশে অবিরাম কোরআন তেলাওয়াতের বিষয়টি দেখতে অনেকেই দূরদুরান্ত হতে আসেন। মসজিদের একজন মুসল্লি জানান, আমার বয়স এখন ৫৬। আমি আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখি এখানে কোরআন পাঠ চলছে। আমার বাবাও এটাই দেখেছেন বলে জানিয়েছেন আমাকে।

 

ধনবাড়ী কলেজের অধ্যাপক সাবেক ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মীর ফারুক আহমাদ জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই এই কোরআন পাঠ দেখে আসছেন। এটি কোনো দিন বন্ধ হয়নি। নবাব নওয়াব আলীর ১৯০৩ সালে তার সব সম্পত্তি ‘নওয়াব আলী খোদা বক্স ধনবাড়ী ওয়াক্ফ এস্টেট’ নামে ওয়াক্ফ করে দেন।

 

 

নওয়াব আলী চৌধুরীর নাতনি জামাই আকবর উদ্দিন আহমেদ জানান, মৃত্যুর আগে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী তার কবরের জন্য যে জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে এবং তার ইচ্ছা অনুযায়ী এই কোরআন পাঠ চলছে। এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

 

যাযাদি/এস