যেভাবে হজরত আলীর (রা.) উপাধি হয় ‘হায়দার’
প্রকাশ | ২৩ জুন ২০২৫, ১০:৩৯

আরবি ‘হায়দার’ শব্দের অর্থ সিংহ। এটি আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রখ্যাত সাহাবি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) অন্যতম উপাধি হিসেবে প্রসিদ্ধ। এটি তার উপাধি হিসেবে প্রসিদ্ধ হয় খায়বারের যুদ্ধের সময়।
খায়বারের যুদ্ধে আলী (রা.) যখন ইহুদি বীরযোদ্ধা অজেয় হিসেবে খ্যাত মারহাবের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি নিজেকে ‘হায়দার’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মারহাব আবৃত্তি করেন,
قَدْ عَلِمَتْ خَيْبَرُ أَنِّي مَرْحَبُ
شَاكِي السِّلاَحِ بَطَلٌ مُجَرَّبُ
إِذَا الْحُرُوبُ أَقْبَلَتْ تَلَهَّبُ
অর্থ: খায়বার তো জানে ভালো করেই যে আমি মারহাব, যুদ্ধের লেলিহান আগুনে অস্ত্রে সজ্জিত অভিজ্ঞ এক বীর।
আলী (রা.) তার জবাবে আবৃত্তি করেন,
أَنَا الَّذِي سَمَّتْنِي أُمِّي حَيْدَرَهْ
كَلَيْثِ غَابَاتٍ كَرِيهِ الْمَنْظَرَهْ
أُوفِيهِمُ بِالصَّاعِ كَيْلَ السَّنْدَرَهْ
অর্থ: আমি সেই ব্যক্তি, যাকে আমার মা হায়দার (অর্থাৎ সিংহ) নামে ডাকতেন। আমি ভয়াল দর্শন বন্য সিংহের মতো, শত্রুকে প্রতিঘাত করি সানদারার মাপে। (বিরাট পাত্রে পরিমাপ করে তাদেরকে উপযুক্ত বদলা বুঝিয়ে দেই।)
এরপর তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়। আলী (রা.) বিজয়ী হন, মারহাব পরাজিত ও নিহত হন।
আলীর (রা.) আবৃত্তি করা এই কবিতার ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহ.) বলেন, জন্মের পর হজরত আলীর (রা.) মা তার নাম রেখেছিলেন ‘আসাদ’ তার নানা আসাদ ইবনে হিশাম ইবনে আবদে মানাফ-এর নামে।
(‘আসাদ’ শব্দের অর্থ সিংহ যার সমার্থক শব্দ ‘হায়দার’।) সে সময় তার বাবা আবু তালিব সফরে ছিলেন। সফর থেকে ফিরে এসে তিনি ছেলের নাম রাখেন আলী।
ইহুদি বীরযোদ্ধা মারহাব স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, একটি সিংহ তাকে হত্যা করছে। আলী (রা.) এই স্বপ্নের কথা জানতেন। তাই তিনি লড়াইয়ের শুরুতেই এই স্বপ্নের কথা মনে করিয়ে দিয়ে নিজেকে সিংহ হিসেবে পরিচয় দেন যেন মারহাব ভয় পান এবং মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
আলীর (রা.) কবিতার সারমর্ম হলো, আমি সেই সাহসী, দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ব্যক্তি, যে সিংহের মতো তোমার সামনে এসেছে। (শরহু মুসলিম লিন-নববী)
সহিহ মুসলিমে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে সাহাবি সালামা ইবনে আকওয়ার (রা.) সূত্রে।
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সঙ্গে আমরা খায়বারের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। পথে আমার চাচা আমির (রা.) প্রেরণামূলক কবিতা আবৃতি করছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে আমরা হেদায়াত পেতাম না, সাদাকাও দিতাম না আর সালাতও আদায় করতাম না।
আমরা আপনার অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী, তাই আপনি আমাদের কদম দৃঢ় রাখুন, যখন আমরা শত্রুদের সম্মুখীন হই এবং আপনি আমাদের প্রতি প্রশান্তি বর্ষণ করুন।’
কবিতা শুনে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এই ব্যাক্তি কে? তিনি বললেন, আমি আমির। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার রব তোমাকে ক্ষমা করুন।
তারপর যখন আমরা খায়বারে উপস্থিত হলাম, তখন খায়বার অধিপতি মারহাব তরবারি দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, খায়বার তো জানে ভালো করেই যে আমি মারহাব, যুদ্ধের লেলিহান আগুনে অস্ত্রে সজ্জিত অভিজ্ঞ এক বীর।
আমার চাচা আমিরও (রা.) বললেন, খায়বার জানে যে, আমি আমির, অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত নির্ভীক বাহদুর।
তাদের মধ্যে আঘাত বিনিময় হল। আমির (রা.) নিচে থেকে যখন তাকে আঘাত করতে চাইলেন, তখন তা ফিরে এসে তার নিজের ওপরই লাগল। নিজের আঘাতেই তার পায়ের গোছার সংযোগ শিরা কেটে গিয়ে তার মৃত্যু হলো।
আমি কয়েকজন সাহাবিকে বলাবলি করতে শুনলাম, (ভুলক্রমে নিজের আঘাতে মারা যাওয়ার কারণে) আমিরের আমল বরবার হয়ে গেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে গিয়ে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ!
আমিরের আমলগুলি কি বরবাদ হয়ে গেল? রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ কথা কে বলেছে? আমি বললাম, আপনারই কয়েকজন সাহাবি। তিনি বললেন, যারা এ রকম বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে। তিনি দ্বিগুণ প্রতিদান পাবেন।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি এমন এক ব্যাক্তিকে আজ পতাকা সমর্পণ করব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলও তাকে ভালবাসেন।
তারপর তিনি আমাকে আলীর (রা.) কাছে পাঠালেন। আলী (রা.) চোখের অসুখে ভুগছিলেন। আমি তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে এলাম।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার চোখে থুথু দিলেন আর তাতেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার হাতে পতাকা দিলেন।
এবারও মারহাব বেরিয়ে এলো এবং বললো, খায়বার তো জানে ভালো করেই যে আমি মারহাব, যুদ্ধের লেলিহান আগুনে অস্ত্রে সজ্জিত অভিজ্ঞ এক বীর।
আলী (রা.) তার জবাবে বললেন, আমি সেই ব্যক্তি, যাকে আমার মা হায়দার (অর্থাৎ সিংহ) নামে ডাকতেন। আমি ভয়াল দর্শন বন্য সিংহের মতো, শত্রুকে প্রতিঘাত করি সানদারার মাপে। (বিরাট পাত্রে পরিমাপ করে তাদেরকে উপযুক্ত বদলা বুঝিয়ে দেই।)
এরপর তিনি মারহাবের মাথায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন এবং তাকে হত্যা করলেন। তার হাত ধরেই বিজয় এলো। (সহিহ মুসলিম: ৪৫২৭)