ইসলামিক বক্তা কাজী ইব্রাহিমকে আটক করেছে পুলিশ

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৫৯

যাযাদি ডেস্ক

 

 

ঢাকায় একজন বহুল পরিচিত ও বিতর্কিত ইসলামিক বক্তাকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

 

কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামে এই ব্যক্তিকে ওয়াজ মাহফিলে নানারকম বিতর্কিত বক্তব্য দেয়ার কারণে বহু মানুষ চেনেন।

 

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার যেমন বিপুল অনুসারী শ্রেণি রয়েছ, তেমনি তাকে নিয়ে সমালোচনা ও ট্রলও কম নেই।

 

বৈজ্ঞানিক ইস্যুতে নানা অবৈজ্ঞানিক বক্তব্য দেয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে ট্রল হয়েছে তাকে নিয়ে।

 

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ফারুক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, অনলাইনে ‘ঘৃণাসূচক, অসত্য ও ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে’।

 

সোমবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে মোহাম্মদপুর কলেজ রোডের বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। এরপর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

 

আটক হবার আগে ফেসবুক লাইভে:

 

সোমবার রাতে যখন ডিবি পুলিশ তাকে আটক করার জন্য বাসায় যায়, তখন তিনি ফেসবুক লাইভে এসে প্রায় ২০ মিনিট ধরে বক্তব্য দেন।

 

সেখানে তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি মুফতি কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলছি। বিগত দুই সপ্তাহে এই দেশের সরকারের কল্যাণে, এ দেশের জনগণের কল্যাণে, এই দেশের স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুটো খুতবা দিয়েছিলাম। সাথে সাথে হিন্দুস্তানি রাজাকার, র-য়ের (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) গুণ্ডারা এই মুহূর্তে আমার বাসায় লালমাটিয়ায় হানা দিয়েছে’।

 

তিনি ভিডিওতে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাকে "গুম" করা হতে পারে।

 

ভিডিওটি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বহু মানুষ ভিডিওটি দেখছেন, শেয়ার করছেন ও প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।

 

এর আগে তিনি বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কারণ হয়েছেন।

 

বিশেষ করে তার ‘স্বপ্নে করোনাভাইরাসে টিকা আবিষ্কারের সূত্র’, ‘ভ্যাকসিন দিয়ে মানুষের শরীরের সব প্রাইভেসি নিয়ে নিচ্ছে’, ‘টিকা নিয়ে মেয়েরা ছেলে হয়ে যাবে’ ইত্যাদি বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিস্তর ট্রল হয়েছে।

 

ইউটিউবে তার এক একটা বক্তব্যের ভিডিও লাখ লাখ বার দেখা হয়।

 

ওয়াজ মাহফিলে কি ধরনের বক্তব্য আসছে, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন মহলের পাশাপাশি সরকারের ভিতরেও আলোচনা ছিল।

 

এ বছরের জানুয়ারিতে ওয়াজ বা ধর্মীয় সমাবেশে কোরান এবং বিশুদ্ধ হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী মাহমুদুল হাসান।

 

তিনি বলেছেন, মাহফিলে অনেক বক্তা কাল্পনিক বক্তব্য, গালগল্প এবং রাষ্ট্রদ্রোহ বক্তব্য দিচ্ছেন। অনেকে গানও করেছেন। যা সমাজে বিভ্রন্তি সৃষ্টি করছে বলে তিনি মনে করেন।

 

মি. হাসান বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে মাহফিলের বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে কোরান হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা চেয়েছেন।

 

জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন কাজী ইব্রাহিম:

 

বৈজ্ঞানিক বিষয়ে অবৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা সম্বলিত বক্তব্য দেয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলের মি. ইব্রাহিম।

 

‘করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার কারণে নারীর দাঁড়ি গজাচ্ছে, পুরুষের কণ্ঠ পাল্টে নারীকন্ঠ হচ্ছে’ এমন এক বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবিসির কাদির কল্লোলকে তিনি বলেছিলেন, ‘সম্ভবত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট সাহেব এটা বলেছেন যে টিকা দেয়ায় নারীর দাঁড়ি গজাচ্ছে এবং পুরুষের কণ্ঠ পাল্টে যাচ্ছে। মিডিয়ায় এই তথ্য এসেছে। আমি কথা কিন্তু গভীর থেকে বলি। ভ্যাকসিন নিয়েও বিতর্ক আছে।’

 

তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যও টেনে এনেছিলেন সেসময়।

 

‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়া, মাস্ক নিয়া বা বিভিন্ন বিষয় নিয়া অনেক কথা বলেছেন। এগুলোতো ভাইরাল হয় এবং মিডিয়া থেকে সাধারণত আমরা তথ্য কালেক্ট (সংগ্রহ) করি,’ তিনি বলেন।

 

কাজী ইব্রাহিম এক বক্তৃতায় করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের গাণিতিক 'সূত্র'ও দিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে "1.q7+6=13" । তার এমন বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বহু হাস্যরস হয়েছে।

 

এ ধরনের বক্তব্যের ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে মুফতি ইব্রাহিম এই সূত্রের বিষয়ে একজন প্রবাসীর স্বপ্ন দেখার কথা তুলে ধরেন।

 

‘ইতালি প্রবাসী একজন বাংলাভাষী তার একটা স্বপ্ন আমাকে বলেছে। স্বপ্নে সে এটা দেখেছে।’

 

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা আছে-তাও তিনি বিস্তারিত বলেন।

 

‘স্বপ্ন ইসলামে তিন প্রকারের হয়। একটা আল্লাহ'র পক্ষ থেকে হয়, এটা সত্য হয়। একটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়, এটা মিথ্যা হয়। আরেকটা নিজের জল্পনা কল্পনা থেকে হয়, এটাও মোটামুটি মিথ্যা হয়।’

 

স্বপ্ন নিয়ে ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেছেন, ‘যেহেতু আল্লাহ'র পক্ষ থেকে ইনফরমেশন হওয়ার একটা সম্ভাবনা অনেক সময় থাকে। এজন্য স্বপ্ন অনেক সময় সত্যও হয়। তাই একজনের স্বপ্নে দেখা ঐ সূত্র দিয়েছিলাম।’

 

কিন্তু এ ধরনের বক্তব্যগুলো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে কিনা-এমন প্রশ্নে মি. ইব্রাহিম বিতর্কের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

 

‘দেখেন, বিতর্কের উৎসটা কী?’

 

তিনি নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেন গত ২০শে জানুয়ারি বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে । তিনি বলেন, কোন বিষয়ে জানার অভাব থেকে সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা হয়।

 

‘আপনি একটা কথা বললে সে সম্পর্কে যদি আমার জ্ঞান না থাকে, তাহলে আমি বলবো এটা কি বললো- আমাদের জানার অভাব থেকেই কিন্তু আমরা যে কোন কথাকে বিদ্রুপ করবো বা উড়িয়ে দেব।’

 

তিনি আরও বলেছেন, ‘যখন জানবো যে একথার ভিত্তি আছে, তখন আর আমরা এসব করব না।’

 

তিনি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনেও বিদ্রুপের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়কে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন।

 

‘বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও তো অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। ইউরোপের মধ্যযুগে বর্তমান বিজ্ঞানীদের পূর্বসূরীদের সবাই নির্যাতিত হয়েছে কমবেশি। তারা মার খেয়েছে, জেল জরিমানা হয়েছে। বিদ্রুপের দ্বারা তারা চরমভাবে জর্জরিত হয়েছে। কারণ তৎকালীন পৃথিবীর মানুষ তা জানতো না। আমার জ্ঞানহীনতার কারণে আমি বিদ্রুপ করতে পারি। কিন্তু এটাতো আমার দেখার বিষয় না’, বিবিসিকে বলেছিলেন তিনি।

 

ধর্মীয় বক্তাদের অনেকে মাহফিলে কোরান হাদিসের বাইরে বক্তব্য দিচ্ছেন বলে যে অভিযোগ জোরালোভাবে উঠছে, সে ব্যাপারে কাজী ইব্রাহিম বলেন, কোরান হাদিসের রেফারেন্সের ভিত্তিতেই বক্তব্য দেয়া উচিৎ।

 

একইসাথে তিনি বলেন, ‘বক্তারা ইচ্ছা করে কোরান হাদিসের বাইরে গিয়ে তথ্য দেন-বিষয়টা এমন নয়। এখন অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল মানুষ মাত্রই হয়।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা

 

যাযাদি/এসআই