শিল্পীরা তাকে ডাকেন 'গিটারের ডাক্তার'

যার হাতের গিটারে সুর তুলেছে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস সহ জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীরা

প্রকাশ | ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯:২২

যাযাদি ডেস্ক

সংগীত জগতে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে গিটার অন্যতম একটি বাদ্যযন্ত্র। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গিটার মেরামতের দোকান দেখা মেলে, তবে সব চেয়ে বেশি দোকান আছে রাজধানীর সাইন্সল্যাব মোড়ে। এখানে সংগীত জগতের গিটার সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা ও মেরামত করার দোকান আছে। তবে সাইন্সল্যাব মোড়ে কলেজস্ট্রিট ওয়েলফেয়ার সোসাইটির গেট দিয়ে এগুলেই ডানপাশে চোখে পড়ে সরু একখানি দোকান। সামনে সাইনবোর্ডে লেখা- রফিক ইলেকট্রনিক্স। 

রফিকের আসল নাম মোহাম্মদ আব্দুর রফিক। তাকে শিল্পীরা সবাই ভালোবেসে ডাকে গিটারের ডাক্তার বলে।সে পেশায় একজন মেকানিক। রফিক ৭০ দশক থেকে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র মেরামতের কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সংগীত জগতে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছেন নিজের মেধা ও কর্মদক্ষতায়। রফিকের সুরু এই দোকানে দেশসেরা সব সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, জেমস থেকে শুরু করে ইব্রাহীম আহমেদ কমল, লাকী আখন্দ কিংবা শাফিন আহমেদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাঁটিয়েছেন।

মোহাম্মদ আব্দুর রফিকের জীবনের প্রথম যাত্রা শুরু হয় এলিফ্যান্ট রোডের 'রেডিও ইলেক্ট্রনিক ইন্ডাস্ট্রি' নামক একটি ওয়ার্কশপে। ওখানে তিনি ( রফিক) সহ একযোগে ভর্তি হন ২৮ জন। রফিকের বয়স ছিল তখন ১৫ থেকে ১৬ বছর। জীবনে কিছু একটা করে খেতে তার জন্যই স্কুল জীবনে মূলত ঢাকায় এসেছিলো।

রেডিও-টেলিভিশনের মেকানিক থেকে কিভাবে গিটারের (গিটারের ডাক্তার) মেকানিক এমন প্রশ্ন করাই মোহাম্মদ আব্দুর রফিক শুরু করে তার জীবনের গল্প।

‘জীবনের যাত্রা শুরু রেডিও ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠানটিতে।ওখানে একযোগে ভর্তি হয় ২৮ জন। ভাগ্যক্রমে আমি চান্স পায় ঢাকায় এবং অপর একজন চান্স পেলো চট্টগ্রাম। তখন ছিল টেলিভিশন এর যুগ। এমলিফার মাইক এগুলোর কাজ করতাম। এরপর মাঝে মধ্যে হাওয়াইন ইলেকট্রিক গিটার পেলে এগুলো সারাতাম।৮০ দশেক দিকে দোকান ছিল মাএ তিনটি । 

এসময় আমাদের কাছে লিড গিটার বা পেজ গিটার  আসতো আগে কখনো এই গিটার গুলো দেখেনি। মূলত হাওয়াইর ইলেকট্রিক গিটার গুলোই সারাতাম। টেলিভিশন লাইনে থাকার কারণে গিটার লাইনে ছিলাম না। হাওয়া ইন গিটার সম্পর্কে বুঝতাম তবে লিড গিটার বা পেজ গিটার সম্পর্কে বুঝতাম না, যেহেতু আমার একটা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল তাই আর বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে বেজ ঠিক ছিল তাই তেমন কোনো  সমস্যা হয়নি। তারপর মার্ক করতে শুরু করি তারপর মোটামুটি একটি আইডিয়া চলে আসে।

গিটার দুইটার দিক আছে একটি হল ইলেকট্রিক আর একটি ইলেকট্রিক ছাড়া ইলেকট্রিক যেটি সেটি আমাদের কাছে যেত গিটারের টেকনিশিয়ান কেউ ছিল না গিটারের একটি সাইট ছিল স্ট্রিম গুলো মিউজিসিয়ান পাট তবে তার টেকনিক্যাল একটা ব্যাপার। ফ্যাক্টরি সেটাপ আমরাই করে থাকতাম। ইলেকট্রিক সাউন্ড শুধুমাত্র আমাদের সাইট আমরা এগুলো পারতাম এর দুইটা পার্ট একটা হচ্ছে গিটার পার্ট আর একটা সাউন্ড এর পার্ট দুইটা পার্ট আলাদা। তবে আমাদের কাছে একটি পার্ট আসলে আর একটি পার্ট রিপেয়ার করতে হতো এভাবে আস্তে আস্তে সব শিখে গেলাম। 

তবে প্রথম প্রথম এগুলা করতে আমাদের একটু অসুবিধায় পড়তে হতো কিন্তু পরবর্তীতে তেমন কোন আর সমস্যা হতো না। আমি সিলেক্ট হলাম কারণ আমার এখানে আমার কপাল বলতে পারি বা আমার মেধা বলতে পারি ২৮ জনের মধ্যে অল্প সময়ে আমি কাজটি নিজের আয়তে আনতে পারি যেমন আমাদের যে ট্রেইনার ছিল বুয়েটের, একজন ট্রেইনার ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির, আর একজন ছিল চট্টগ্রামের উনি ছিলেন আমাদের প্রোপাইটার আমাদের ট্রেনিং দিত। 

আমার খুব দ্রুত টেকনিক্যাল জিনিসটা নিজের আয়তে চলে আসতো। আমাদের যে স্যার ছিল তিনি দেখলেন যে আমি কাজগুলো ভালো পারি তাই আমাকে আস্তে আস্তে কাজগুলো দিতে থাকেন। 

আগেকার সময় রেডিও গ্রামের টাইল কট নামে একটি জিনিস ছিল ট্রেনিং সেন্টারের স্যারেরা এগুলো ঠিক করছিল তারপর তারা আমাকে এটি দিয়ে চা খেতে চলে গেলেন আমাকে বলল তুমি এটি ঠিক কর একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো আমি আধা ঘন্টার ভিতর এটিকে ঠিক করে ফেললাম ওদের কাজ দেখে আমার নিজের মধ্যে একটি আইডিয়া চলে আসছে কোন টেকনিকে গেলে আমি এটিকে দ্রুত সারাতে পারবো ওখান থেকে আমি কিছু শিখে নিয়েছি। বস আসলো এবং আমার কাজটি দেখে অবাক হয়ে গেল এবং তারপর থেকে আমাকে আস্তে আস্তে কাজ দিতে থাকে।

তবে তখন সেরকম কাজ পেতাম না। আজ একটা হয়তো গিটার পেলাম আবার ৬ মাস পরে একটা গিটার পেতাম। প্রথম গিটার পেয়েছিলাম হাওয়া ইন গিটার এরপর হ্যাপি লাকী আখন্দ ভাইয়ের গিটার আসল। তারপর ১৯৮৩ সালে বাচ্চু ভাইয়ের ইন্ডিয়ান গিফট সং গিটার পেলাম।’

আব্দুর রফিক যখন শুরু করেছিলেন, বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি খুব বেশি বড় ছিল না। বিশেষ করে গিটার কিংবা ইলেক্ট্রিক গিটার বাদক ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। সেই আশির দশক থেকে শুরু করে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত রফিকই ছিলেন ঢাকা শহরের একমাত্র লোক, যিনি গিটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্র মেরামত করতে পারতেন। ফলে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বড় হওয়ার সাথে সাথে কাজ ও খ্যাতি বাড়তে থাকে রফিকের।

রফিক বলেন, আমাকে তখন কেউ এত চিন্তেন না।আস্তে আস্তে এভাবেই কাজ বাড়তে থাকি। ৯০ দশকে প্রচুর কাজ আসতে থাকে। যদিও দোকানটি খুব ছোট ছিল। তবে দোকানের পুরা জায়গা জুড়ে ছিল গিটার। আমার কাছে সেই ৭০ দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেক গিটার এসেছে। আমার রাজত্বকালে আমি একাই ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছি প্রায় ৩০-৪০ বছর। ব্রান্ড জগতে অনেক শিল্পী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার কাছে গিটার রিপেয়ার করেছেন। জেমস, লাবু ভাই, নিলয়দা আরও অনেকে গিটার রিপেয়ার করেছেন। 

তখন আমি ছাড়া তেমন কেউ ছিল না রিপিয়ার করলে আমি করতাম। আমি ছাড়া বিকল্প আর কেউ ছিল না যাকে দিয়ে কাজ করানো যেত। আমি স্কুল জীবন থেকে এই কাজে এসেছিলাম। এসেছিলাম আমাকে কিছু একটা করে খেতে হবে আশির দশকে এসে এটা পেশা হিসেবে হয়ে গেছে। 

যাযাদি/ এম