শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অরিত্রীর স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে আছেন তার হতভাগ্য মা-বাবা

যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৬:৫৩

বড্ড অভিমানী মেয়ে অরিত্রী অধিকারী। তাই অভিমান নিয়েই অকালে চলে গেলো সবাইকে ছেড়ে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি বুকে আঁকড়েই বেঁচে আছেন হতভাগ্য মা-বাবা। মেয়ের ব্যবহার করা রুমটি আগের মতই যত্ম করে রেখেছেন তারা। যেন অরিত্রী এখনো তাদের মাঝে আছে। সেই গিটার, টেবিলের ওপর সাজানো বই, খাটে পড়ে থাকা বালিশ সবকিছুই যেন ঠিক আগের মতই। তবুও রঙ্গিন ঘরটি অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এই ঘরটির আলোয়ও তো ছিলো অরিত্রী। সাজানো গোছানো সেই রুমে নেই শুধু অরিত্রী।

দুই বছর আগে ২০১৮ সালের এই দিনে (৩ ডিসেম্বর) শিক্ষকদের দ্বারা বাবা-মার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন অরিত্রী অধিকারী। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ। গত বছর ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম। চার্জ গঠনের ১৭ মাস পার হলেও মামলাটিতে এখন পর্যন্ত মাত্র তিন জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। আগামি ৯ ডিসেম্বর মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেন আদালত।

বুধবার রাতে মোবাইল ফোনে কথা হয় অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারীর সাথে। কেমন আছেন? জানতে চাইলে দীর্ঘ নি:শ্বাস নিয়ে বলেন, আর কেমন থাকতে পারে একজন মেয়ে হারানো বাবা।

তিনি বলেন, মেয়েকে হারিয়েছি দুই বছর হয়ে গেলো। মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করে চলে গেলো। সে তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু আমরা তো তাকে ছাড়া মোটেই ভালো থাকতে পাচ্ছি না। শিক্ষকরা এমন দুর্ব্যবহার করেন জানা ছিল না। সেদিন যদি তারা আমাদের আলাদা ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলতেন তাহলে আর মেয়েকে হারাতে হতো না।

দিলীপ অধিকারী বলেন, মেয়েকে তো আর ফিরে পাবো না। তবে তার সাথে যারা খারাপ ব্যবহার করেছে, যার জন্য ওকে পৃথিবী ছেড়ে অকালে চলে যেতে হয়েছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয় সে জন্য লড়ে যাবো। যেন আর কোনো মা-বাবাকে এ অবস্থা দেখতে না হয়।

তিনি বলেন, যে মেয়ে আমার ঘর আনন্দে ভরে রাখতো তারা তো তাকে বাঁচতে দিল না। প্রতিটা জায়গায় তার স্মৃতি রয়েছে। ও যে রুমে ছিলো সে রুমটা এখনো সে রকমই রয়েছে। সাজানো গোছানো সেই রুমে শুধু অরিত্রী নেই। তবে রুমে ডুকলেই নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কষ্টের পাথর যেন আমাকে চেপে ধরে। অসহ্য, সইতে পারিনা। এ থেকে মুক্তি চাই। মেয়েটা চলে গেছে, কিছুই করতে পারিনি। এখন বাসাটাও ছেড়ে দিবো। যদি ক্ষনিকের জন্য তার স্মৃতি ভুলে থাকা যায় কষ্টটা হালকা হয়।

স্বল্প সময়ের মধ্যে অরিত্রীর মামলার বিচার শেষ হবে এমন আশা বাবা দিলীপ অধিকারীর। তিনি বলেন, যারা অন্যায় করছে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লড়ে যাচ্ছি। আদালত আশ্বস্ত করেছে, ন্যায়বিচার পাবো। আদালতের ওপর ভরসা রাখছি। হাল ছাড়বো না। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ লড়ে যাবো।

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী বলেন, দুই বছর আগে অরিত্রী আমাদের সাথে ছিল। আর আজ সে কোথায় আছে। দুই বছর মেয়েটাকে দেখি না। ওকে ছাড়া ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে। হাঁটতে, চলতে ওর কথা মনে পড়ে। রান্নাঘর বা বারান্দায় যখন দাঁড়িয়ে থাকি, তখন যদি কোনো শিক্ষার্থীকে দেখি স্কুল ড্রেস পড়ে যাচ্ছে, তখন মনের ভিতর হাহাকার শুরু হয়। তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনা। চোখে জল চলে আসে।

তিনি বলেন, অরিত্রী ছিল চঞ্চল প্রকৃতির। সবাইকে সব সময় হাসিখুশি রাখতো। সবদিকে খেয়াল রাখতো।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাবিনা আক্তার (দিপা) বলেন, এটি একটি আলোচিত মামলা। সেদিন অরিত্রী ও তা মা-বাবা আসামিদের পা ধরে মাফ চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের একটুও দয়া হয়নি। তাদের একটু দাম দেয়নি। অপমাণ সইতে না পেরে অরিত্রীকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অরিত্রীর বাবা-মা মেয়েকে হারিয়েছে, ইজ্জত হারিয়েছেন। মামলাটির বিচারকাজ শেষ করতে আমরা তৎপর আছি। মামলাটিতে তিন জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সাক্ষী এনে মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত এগিয়ে নেব। মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় এবং ভূক্তভোগীরা যেন ন্যায় বিচার পায় এজন্য আমরা চেষ্টা করে যাবো।

অরিত্রীর আত্মহত্যায় ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে গত ৪ ডিসেম্বর রাতে দ-বিধির ৩০৫ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, গত ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে, এমন অভিযোগে অরিত্রীকে পরদিন তার মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওই দিন স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। মেয়ের টিসি নিয়ে যেতে বলেন। পরে প্রিন্সিপালের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরে বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা অরিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫ ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

গত বছর ২০ মার্চ নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার। আর শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

চার্জশিটে ১৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। সেই মোবাইল ফোন, পরীক্ষার খাতাসহ ছয় প্রকার আলামত জব্দ করা হয়েছে।

এদিকে দুই আসামির বিরুদ্ধে যে ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে উক্ত ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃতুদ-ও হতে পারে। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদ- বা ১০ বছর কারাদ-ের বিধান রয়েছে। কারাদ-ের পাশাপাশি অর্থদ-েরও বিধান রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে