শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এত বাসে আগুন দিল কারা!

সাখাওয়াত হোসেন
  ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৫৯

কলেজ ছাত্রীকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে সোমবার দুপুরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রামপুরা সড়কে অবস্থান নিলেও পুলিশের মধ্যস্থতায় বাস-মালিক পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার পর রাস্তা থেকে সরে যায় তারা। বিকালের পর ঘটনাস্থলের আশপাশে শিক্ষার্থীরা কেউই ছিলেন না। অথচ রাত পৌনে ১১টায় বাসচাপায় একরামুন্নেছা স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী মাঈনউদ্দিন দুর্জয় নিহত হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৮টি বাসে অগ্নিসংযোগ এবং কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। এ সময় দমকল বাহিনীর গাড়ি দ্রম্নত ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করলে তাতেও বাধা দেয় একদল যুবক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাঈনউদ্দিনের সহপাঠীসহ একরামুন্নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আশপাশের অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই গাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। যারা গাড়িতে আগুন দিয়েছে তারা ঘটনা ঘটিয়েই দ্রম্নত ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। রাতের অন্ধকারে অগ্নিসংযোগকারীদের স্পষ্টভাবে চেনা না গেলেও তারা স্থানীয় লোকজন নন বলে মনে করেন ঘটনাস্থলের আশপাশের দোকানিরা। এ অবস্থায় এত স্বল্প সময়ে এতগুলো গাড়িতে আগুন দিল কারা- এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। গাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় গানপাউডার কিংবা ডিজেল-পেট্রোলসহ দাহ্য কোনো পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা তা এখন সবারই জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ৮টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও চরম দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। তারা গোটা ঘটনাটি রহস্যজনক মনে করছেন। এটি কোনো পরিকল্পিত নাশকতা কিনা? ষড়যন্ত্রকারীরা আগে \হথেকেই এ ধরনের অঘটন ঘটানোর জন্য ওঁৎ পেতে ছিল কিনা? এসব প্রশ্ন তাদের এখন ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাসে অগ্নিসংযোগের পর থানা পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দ্রম্নত ঘটনাস্থলে পৌঁছে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চালান। তারা অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করতে পারেননি। এ সময় ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত স্কুলছাত্র মাঈনউদ্দিনের ঘাতকদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা কেউ বাসে অগ্নিসংযোগে জড়িত ছিল না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ যায়যায়দিনকে বলেন, এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো গাড়িতে অগ্নিসংযোগের বিষয়টি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। সুযোগসন্ধানীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাসে আগুন দিতে পারে- বেশকিছু আলামত দেখে এমনটাও মনে হয়েছে। পুলিশ সার্বিক বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখছে। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে রাতেই মামলাটি রুজু করে। ডিসি জানান, পুলিশ নিহতের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি পুলিশকে বলেছেন, তারা গাড়ি ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ করেননি। অন্য কেউ এসে এসব করেছে। গোয়েন্দারা জানান, গণপরিবহণে হাফ ভাড়া ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারীরা নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঘটাতে পারে বলে তারা আগেভাগেই সরকারকে সতর্ক করে। সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের প্রতিটি আন্দোলন কর্মসূচিতেই গোয়েন্দারা তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছে- যাতে বহিরাগত দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের বেশে আন্দোলনে ঢুকে পড়ে কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটাতে না পারে। সোমবার রাতে রামপুরা টিভি ভবনের সামনের রাস্তা কিংবা আশপাশের এলাকায় কোনো শিক্ষার্থীদের কোনো আন্দোলন কর্মসূচি ছিল না। এ কারণে ওই সময় এ এলাকায় গোয়েন্দারা অনুপস্থিত ছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বলে মনে করেন তারা। দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, থানা পুলিশের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার ছায়াতদন্ত করছে। তারা ঘটনাস্থলের আশপাশের কোনো বাসা-বাড়ি, অফিস, দোকানপাট কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরায় বাসে অগ্নিসংযোগের কোনো ফুটেজ পাওয়া যায় কিনা তা খতিয়ে দেখছে। কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে স্থানীয় এলাকাবাসী, দোকানি ও প্রত্যক্ষদর্শী পথচারীদের কাছ থেকে অগ্নিসংযোগকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা ওই কর্মকর্তার দাবি, যতটা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এতোগুলো বাসে একসঙ্গে আগুন দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে নাশকতাকারীদের পেশাদার দুর্বৃত্ত বলে মনে হচ্ছে। তাদের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা বিশেষ কোনো ষড়যন্ত্রকারী চক্র এ কাজে লাগিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নাশকতাকারীরা যত সাবধানতার সঙ্গে এ অপকর্ম ঘটিয়ে থাকুক না কেন তাদের দ্রম্নত চিহ্নিত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর পুলিশের ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, একসঙ্গে এতোগুলো বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা চলতি বছরে ঘটেনি। ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শাহবাগ, প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, মতিঝিল, নয়াবাজার, ভাটারা, শাহজাহানপুরসহ ৯টি স্থানে ৯টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ঢাকা-১৮ আসনে উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী কোনো পক্ষ নাশকতার উদ্দেশ্যে বাসে আগুন দেয় বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করে গোয়েন্দারা। পরে নানামুখী তদন্তে এর সত্যতা পাওয়া যায়। রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, রামপুরা এলাকায় ৮টি বাসে অগ্নিসংযোগ ও ৪টি বাস ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪/৫শ' ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিবিড়ভাবে স্পর্শকাতর এ মামলার তদন্ত করছে। প্রত্যক্ষদর্শী কেউ এখনো দুষ্কৃতিকারীদের কারও পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, এরই মধ্যে তারা ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়টি ভবনে কতটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে তার তালিকা তৈরি করেছে। তারা বাড়ি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে পর্যায়ক্রমে এখন এসব ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করবে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের কাছ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। যা নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, সোমবার রাতে ৮ বাসে অগ্নিসংযোগের পর থানা পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ফুট ও কার পেট্রোল এবং গোয়েন্দা নজরদারি। ওই কর্মকর্তা জানান, বুধবার সকাল থেকে রামপুরা সড়কে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা নগরীর বিভিন্ন সড়কে আকস্মিক অবস্থান নিতে পারে। এসব কর্মসূচিতেও দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই নগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন ছক সাজানো হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে