খাদ্যবহির্ভূত খাতেও আগুনের আঁচ

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দর সমন্বয়ের কথা বলে বিভিন্ন খাতের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মূল্যবৃদ্ধির তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৬ মে ২০২২, ০৯:১৩

সাখাওয়াত হোসেন

দেশে তেল-পেঁয়াজ, মাছ-মাংস ও চাল-ডালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের অগ্নিমূল্য নিয়ে হইচইয়ের ফাঁকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামও হু হু করে বেড়েছে। এর প্রভাবে এরইমধ্যে অনেকটা নিঃশব্দে বস্ত্র, বাসস্থান, যাতায়াত, পণ্য পরিবহণ ও চিকিৎসাসহ সব ধরনের সেবা খাতেই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তৎপরতা নানা 'খোঁড়া যুক্তি' দাঁড় করানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ সুযোগে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দর সমন্বয়ের কথা বলে বিভিন্ন খাতের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মূল্যবৃদ্ধির তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যদিও এরমধ্যে অনেক পণ্য দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়া পণ্যও আকাশচুম্বী মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে একচেটিয়া দখল থাকার কারণে খাদ্যবহির্ভূত বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদক কোম্পানিগুলো এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন দাম বাড়াতে পারছে। কোনো একটি কোম্পানি নিজের পণ্যের দাম বাড়ালে তাকে অনুসরণ করে অন্যরাও সমজাতীয় ওই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে প্রতিযোগিতা পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে হওয়ার কথা থাকলেও, তা দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে হচ্ছে। ফলে মান না বাড়লেও একই পণ্যের দাম ছয় মাসের ব্যবধানে কয়েকগুণ বেড়েছে। এজন্য কারো কোনো জবাবদিহিতা না থাকা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে খোদ সরকারের উদাসীনতাকে বাজার বিশ্লেষকরা দায়ী করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, মানুষের ভোগ্যপণ্যের তুলনায় খাদ্যবহির্ভূত পণ্য খাতে খরচ বেড়েছে। বিবিএস প্রকাশিত মূল্যম্ফীতির তথ্যেও খাদ্যবহির্ভূত খাতের মূল্যম্ফীতি বাড়ার চিত্র মিলেছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, গৃহস্থালি সংশ্লিষ্ট এসব পণ্যের ক্রমাগত দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানারকম চটকদার বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নিচ্ছে। একই পণ্যের বিজ্ঞাপন নানা রঙে, নানা ঢঙে দেখানো হচ্ছে। উৎপাদক কোম্পানিগুলো পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বিজ্ঞাপন ও বাজারজাতকরণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের বিজ্ঞাপন ও বিপণনের খরচ উৎপাদন খরচকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর এ বর্ধিত খরচ কৌশলে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের বাড়তি চাপে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খরচের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশকিছু দিন ধরে সাবান, সোডা, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট, লোশন, বেবি অয়েলসহ গৃহস্থালির বিভিন্ন পণ্য ও টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো একই পণ্যের দাম মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দু'বার বাড়িয়েছে বলে খুচরা ও পাইকারি দোকানিরা স্বীকার করেছেন। কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক হিসাবমতে, বাসাবাড়িতে নিত্যব্যবহারের প্রসাধন পণ্যের দাম গত এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। চাল, ডাল ও তেলের দাম কিছুটা বাড়লে চারদিকে হইচই পড়লেও নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ক্ষেত্রে তা না হওয়ায় উৎপাদকরা এ সুযোগ নিচ্ছে। ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, কাপড় কাচা সাবানের দাম স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ বেড়েছে। গত এক বছরে একটি বহুজাতিক কোম্পানির ৫০ গ্রামের টুথপাউডারের কৌটার দাম ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। দেশি একটি কোম্পানির টয়লেট পেপারের দাম এক বছরের ব্যবধানে ১৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকা। ২৩ টাকার বাসন পরিষ্কার করার সাবান হয়েছে ৩০ টাকা। ৪৫ টাকার আধা কেজি ডিটারজেন্টের দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা। রিন এক কেজি কিনতে ক্রেতাকে এখন দিতে হচ্ছে ১৩৫ টাকা, আগে এটার দাম ছিল ১২০ টাকা। দেড়শ গ্রাম লাক্স সাবান কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ টাকা, যেটা আগে ছিল ৫২ টাকা। ১০০ গ্রাম লাক্স সাবান ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা। এভাবে গত কয়েক মাসে বিভিন্ন টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কনজু্যমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যমূল্যও অসহনীয়। নিত্য-ব্যবহার্য এসব পণ্য কিনতেই মানুষের আয় শেষ হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন শুধু খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ তদারকি করছে। তিনি জানান, ঘরে ব্যবহার করা বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম অন্তত ১০ শতাংশ। আর প্রকারভেদে এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যের দাম ২ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা কনজু্যমার ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল বছরের তুলনায় এখন ক্রেতাদের সাবান, ডিটারজেন্ট ও হ্যান্ডওয়াশ কিনতে হচ্ছে ১০ শতাংশ বেশি দামে। থালা-বাসন পরিষ্কার করার উপকরণ ভিমবারের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ। হারপিক ও লাইজলের দর বেড়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ করে। সংস্থাটির দাবি, এই সময়ে টুথপেস্ট ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ, টিসু্য বা সমজাতীয় পণ্যের দর ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে, সরকারিভাবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই। ওই সংস্থাটি জানুয়ারি মাসে শহর এলাকার চার শ্রেণির মানুষের জীবনমানের তথ্য হিসাব করে মূল্যস্ফীতির হার ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং গ্রামে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ নির্ণয় করেছে। ফেব্রম্নয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলে ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১১ সালের পর এত বেশি মূল্যস্ফীতি (১১.৩৮ শতাংশ) আর কখনো অনুভূত হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষ জাতীয় আয় বৃদ্ধির সুখ তত বেশি অনুভব করে না, যত বেশি কষ্টভোগ করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে। মূল্যস্ফীতি তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। তাই টিসিবির সস্তা পণ্য ক্রয়ের জন্য তাদের ট্রাকের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, খাদ্যপণ্যের মূল্যের ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে, এসব পণ্যের ব্যাপারে সেভাবে কিছু করার থাকে না। তবে অতিদ্রম্নত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তা না হলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কঠিন চাপে পড়বে। এদিকে শুধু নিত্যব্যবহার্য পণ্যেই নয়, খাদ্যপণ্যের চড়া দরের প্রভাব এখন জীবনযাত্রার আনুষঙ্গিক খাতে পড়েছে। এতে যাতায়াত, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ব্যয় এবং শিক্ষা উপকরণসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের ক্রয় খরচও বেড়েছে। সংসারের অতিরিক্ত খরচ সামাল দিতে গিয়ে সীমিত আয়ের বেশিরভাগ মানুষকে তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাল-ডাল, আটা-ময়দা, তেল-পেঁয়াজ ও মাছ-মাংস-সবজিসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় জীবন বাঁচার তাগিদে নগর-মহানগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষসহ রিকশাচালক, সবাই মজুরি বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেম্পু, অটোরিকশা, লেগুনা চালকরাও একইভাবে আগের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের যাতায়াত খরচ বেড়েছে। পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-চালকরাও একই দলে যোগ দেওয়ায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্য পরিবহণ খরচও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাবে সব ধরনের পণ্যের বাজারদর ক্রমেই বাড়ছে। এদিকে খাদ্যপণ্যের সঙ্গে পালস্না দিয়ে ভোগ্যপণ্যের দর বাড়ায় বাড়ির মালিকরা তাদের বাসাভাড়া বাড়াতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে বস্তিঘর, কাঁচা ও আধাপাকা ঘরের ভাড়া গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। পাকা ঘর ও ছোট ফ্ল্যাটের ভাড়াও সে তুলনায় কিছুটা কম বাড়লেও সীমিত আয়ের ভাড়াটিয়াদের এ বাড়তি টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিম্নবিত্তের ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, খাদ্য ও নিত্য ব্যবহার্য প্রায় সব পণ্যের দর বৃদ্ধিতে এমনিতেই তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এর উপর বাড়ি মালিকরা অনৈতিকভাবে আকস্মিক বাড়িভাড়া বাড়ানোর কারণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তবে বাড়ির মালিকরা অনেকে এ ব্যাপারে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়েই তাদের সংসারের সব খরচ চালাতে হয়। তাই সীমিত আয়ের ভাড়াটিয়ারা বিপাকে পড়লেও দ্রব্যমূল্যের চড়া বাজারে তারা বাড়ি ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। নতুন করে বাড়ি ভাড়া বাড়িয়েও তাদের সংসার আগের মতো চলছে না বলে দাবি করেন বাড়ি মালিকরা। এদিকে পণ্য পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির কথা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিকরা সরাসরি স্বীকার না করলেও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার ট্রাক ভাড়া ছিল ২৫ হাজার টাকা, এখন তা ৩২-৩৩ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। একইভাবে ১২ টন ধারণক্ষমতার কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ২২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৬ হাজার টাকা করা হয়েছে। ট্রাক ভাড়া এলাকা ভেদে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, কোথাও কোথাও আরও বেশি বেড়েছে। এছাড়া লোড-আন লোডিং চার্জও আগের তুলনায় বেশ খানিকটা বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে পণ্য পরিবহণে তাদের বাড়তি খরচ হচ্ছে। আর তা পুষিয়ে নিতে তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে। এদিকে শিক্ষা খাতে খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, সাদা কাগজ ও খাতাসহ প্রায় সব ধরনের স্টেশনারি পণ্যের দাম খুব অল্প সময়ের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউটররাও তাদের টিউশন ফি বাড়িয়েছে। রিকশা ভাড়া বাড়ায় স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টারে আসা-যাওয়ায় তাদের বাড়তি খরচ হচ্ছে। রাজধানীর শান্তিনগর, ফার্মগেট ও মালিবাগের বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ঘুরে তাদের টিউশন ফি বাড়ানোর তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। কোচিং সেন্টারের মালিকরাও অনেকে এ বিষয়টি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। তারা জানান, খাদ্যপণ্য, বাসাভাড়া, যাতায়াত খরচ ও অন্যান্য খাতের খরচ বাড়ায় শিক্ষকরা এখন আগের বেতনে চলতে পারছেন না। তাই তারা তাদের বেতন বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। যার প্রভাব টিউশন ফি'তে পড়েছে।