আত্মমর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতিগতভাবে যে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রত্যয়ে ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মমর্যাদায় টিকে থাকবে।

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২২, ০৯:১০

এ কে এম এ হামিদ


পদ্মা সেতু। এশিয়ার ১১তম এবং বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সেতু। এ সেতু রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া একটা জাতির আবেগ, আকাক্সক্ষা, প্রত্যয় ও সক্ষমতার প্রতীক। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধের বলিষ্ঠ প্রকাশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের গণমুখী উন্নয়নের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ উপাদান। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশক সময়কালে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং মেগা প্রকল্প। এ সেতুর প্রতিটি কর্মপরিকল্পনায় জাতির অস্তিত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি জড়িত। কেননা, এ সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে পানি কম ঘোলা করা হয়নি। তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করা যায়, ১৯৯৮-৯৯ সালে সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ২০০৩-০৫ সালে সম্ভাব্যতা পরীক্ষা, ২৮ আগস্ট ২০০৭ তারিখে একনেকে অনুমোদন, ২০০৯-১১ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, ১১ নবেম্বর ২০১০ সালে সেতুর দরপত্র আহŸান, ১১ নভেম্বর ২০১১ সালে রেলপথ যুক্ত করে প্রকল্প সংশোধন, ২৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে আইডিবির সঙ্গে, ২৮ এপ্রিল ২০১১ তারিখে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে, ৬ জুন ২০১১ তারিখে এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। কিন্তু কাল্পনিক ভুয়া দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ২৯ জুন ২০১২ তারিখে ঋণচুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে অন্যান্য দাতা সংস্থাও ঋণচুক্তি থেকে পর্যায়ক্রমে সরে গেলে ৯ জুলাই ২০১২ তারিখে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আমাজনের পর পদ্মা নদীই বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবহমান নদী। যে নদীর অববাহিকায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। তাই নানাদিক, বিশেষ করে পলি মাটির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পদ্মার নদী শাসনে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, নদী শাসন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মুল লক্ষ্য হলো নদীর গতিপথকে এমনভাবে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা যাতে নদীর জলরাশির প্রবাহ সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদী শাসনে যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তাকে বলা হয় গাইড ব্রান্ড উইথ ফলিং অ্যাপ্রোন। এ কৌশলে নদীর পাড় থেকে যত দূর খনন করা যায় সেটিই করা হয়েছে। এতে আধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে পদ্মার পাড় থেকে ২০-২৫ মিটার খনন করে ঢাল তৈরি করা হয়েছে। এ ঢালে ফেলে রাখা হয়েছে ভারী পাথর ও বালুভর্তি জিও ব্যাগ, যাতে কোনো কারণে নরম মাটি ভেঙে গেলে ভারী পাথর বা ব্যাগ নিচে গিয়ে শক্ত স্তর সৃষ্টি করতে পারে। পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারে খনন করা হয়েছে প্রায় ১২২ মিটার, যা ৪০ তলা ভবনের উচ্চতার সমান। এখানে ৩ মিটার ব্যাসের ইস্পাতের টিউবকে কিছুটা বাঁকাভাবে হ্যামার দিয়ে মাটিতে প্রবেশ করানো হয়েছে। পদ্মা সেতু ভ‚মিকম্প সহনীয় একটি শক্তিশালী অবকাঠামো। ভ‚মিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় এখানে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ভ‚মিকম্পের সময় মাটিতে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তার সবটুকু যেন সেতুর উপরি কাঠামোতে যেতে না পারে সেজন্য ব্যবহার করা হয়েছে ১০ হাজার টন সক্ষমতার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং (ভৎরপঃরড়হ ঢ়বহফঁষঁস নবধৎরহম) বা এফপিবি প্রযুক্তি। এটি ব্যবহার করায় ভ‚মিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতু কাঠামোতে প্রভাব পড়বে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এফপিবি প্রযুক্তি ব্যহারের ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গেছে। বজ্রপাতে যেন পদ্মা সেতুর কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে কপার ক্যাবলের আর্থিং। এই ক্যাবলটির একটি প্রান্ত স্ক্রুর সাহায্যে রোডওয়ে ¯øাবের নিচে লাগানো হয়েছে। আর অন্য প্রান্তটি লাগানো হয়েছে স্প্যানে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি বজ্রপাত হয় তাতে উৎপন্ন হওয়া বিদ্যুৎ প্রথমে রোড ¯øাবের সঙ্গে সংযুক্ত ক্যাবলের মাধ্যমে স্প্যানে আসবে। এরপর পিলারের সাহায্যে এই বিদ্যুৎ স্প্যান থেকে একদম মাটির গভীরে চলে যাবে। পদ্মা সেতুর ১৭-১৮টি ¯øাব পরপর এই কপার ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে। এ সেতুতে মোট ৬৫৯টি পাইলিং করা হয়েছে, যার প্রতিটির গভীরতা ১০১.১৩ থেকে ১২৫.৪৬ মিটার বা ৩২৫.৪২ থেকে ৪০৭.৫০ ফুট। এ সেতুর অন্যতম সংযোজন হলো ৭৬২ মিলিমিটার ব্যাসের গ্যাস সরবরাহ লাইন, ১৫০ মিলিমিটার ব্যাসের ফাইবার অপটিক্যাল ও টেলিফোন লাইন। মূল সেতুর ২ কিলোমিটার নিচের জলপ্রবাহে পাইল ফাউন্ডেশনের ওপর সাতটি উচ্চ বৈদ্যুতিক ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইন পরিবহণ সুবিধা রাখা হয়েছে।
সব ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও প্রতিক‚লতা জয় করে বাংলার মানুষকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতুসহ সর্বমোট ৯.৮৩ কিলোমিটার এবং ২২ মিটার প্রস্থের পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এ সেতু নির্মাণ বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন উচ্চতায় স্থান করে দিয়েছে। এ সেতু মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরকে, যেটি আগামী ২৫ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন সেতুর স্বপ্নের কারিগর জননেত্রী শেখ হাসিনা। বস্তুত নিজস্ব অর্থায়নে এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের আত্মগৌরবের জায়গাটিকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। পদ্মা সেতু শুধু নিছক একটি সেতু নয়, এটি আমাদের অনন্য গৌরব, মর্যাদা আর অহংকারের প্রতীক, যেখানে জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয় আর দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। এ সেতু নির্মাণে অর্থ যোগানের নেপথ্য কারিগর ছিলেন দেশের প্রবাসী, তৈরি পোশাক ও কৃষি খাতের শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা শ্রমলব্ধ বৈদেশিক মুদ্রার যোগান। যাদের আয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি। তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে দুঃসাহসী নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থনীতির ভিত্তি গড়ার মূল কারিগর দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রমত্তা পদ্মায় এ সেতু নির্মাণে অর্থের যোগানের পাশাপাশি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও ছিল নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জ ধাপে ধাপে মোকাবিলা করে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সেতু ও দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩.৬৮ কিলোমিটার আজ দৃশ্যমান। ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান (প্রতিটি স্প্যানের ওজন ৩১৪০ টন) এবং ৮১টি পিলারের ওপর নির্মিত সেতুটি চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এ সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নতুন করে গড়ে উঠবে ভারি শিল্পকারখানা। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে প্রথমত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে, বাড়বে বিনিয়োগ। দ্বিতীয়ত, কৃষক উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহজে পরিবহণ করতে পারবেন এবং পণ্যের ভালো দাম পাবেন। তৃতীয়ত, সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার হবে।
কার্যত অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এডিবির এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে-পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে ২৪ হাজার যানবাহন চলবে। তার মধ্যে বাস চলবে ৮ হাজার ২৩৮টি, ট্রাক ১০ হাজার ২৪৪টি, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে ৫ হাজারের বেশি। সমীক্ষায় আরও প্রাক্কলন করা হয়েছে, ২০২৫ সালে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮০০টি। ২০৩০ সালে হবে ৩৬ হাজার ৭৮৫টি। ২০৪০ সালে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৮০৭টি। পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষা মতে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে। দক্ষিণ বঙ্গে শিল্পায়নের গতি ব্যাপক বেড়ে যাবে, যা ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনায় বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের ন্যায় যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সুবিধা হবে। ঢাকা থেকে খুলনা, মোংলা, বরিশাল, কুয়াকাটা অর্থনৈতিক করিডর খুলে যাবে। এ সেতুকে ঘিরে বিশদ অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। সেতু ঘিরে পদ্মার দু’পাড়ে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র ওই অঞ্চলের যাতায়াতের অনুপযোগিতায় পর্যটকদের অনাগ্রহের বিষয় থাকলেও পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সেটি দূর হবে। সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের অনাগত স্বপ্ন পূরণে অগ্রণী সারথি হিসেবে কাজ করবে।
পদ্মা সেতু নিছক একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু নয়। প্রমত্তা পদ্মায় সেরা প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তিতে নির্মিত এই দ্বিস্তরের দৃষ্টিনন্দন পদ্মা সেতুটি দেশের ১৮ কোটি মানুষের আবেগের নাম। স্বপ্ন পূরণে বিশ্বাস ও আস্থার সার্থক রূপায়ণ। আগামী ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের আলো প্রজ্বলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠবে এদেশের কোটি মানুষের প্রাণের আনন্দ-উচ্ছ¡াস। সমগ্র জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই ইতিহাসের কালের সাক্ষী এবং অনন্য গৌরবের অংশীদার হতে। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পকে বহুমুখী প্রকল্পে রূপায়ণের জন্য আইডিইবি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অব্যাহতভাবে সরকারের নিকট সুপারিশ/পরামর্শ প্রদান করে আসছে। যখন প্রমত্তা যমুনা নদীর এপার থেকে ওপারে বৈদ্যুতিক লাইন সঞ্চালনের জন্য ইস্ট ওয়েস্ট ইন্টারকানেক্টরের জন্য বৈদ্যুতিক পিলার নির্মাণ হচ্ছিল, তখন আইডিইবি বৈদ্যুতিক পিলারগুলোকে বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী করে নির্মাণের দাবি জানায়। অনুরূপভাবে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণকালেও একই দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার বিষয়টি আমলে না নিলেও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে রেললাইন সংযুক্ত করা হয়। আইডিইবি’র সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন হওয়ায় এদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা আনন্দিত। পদ্মা সেতুতে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে যখন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতাসংস্থা অর্থায়ন থেকে সরে যাচ্ছিল তখন আইডিইবি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ডক্টর ফরাসউদ্দিন আহমেদ এবং দেশের প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদদের অংশগ্রহণে ঢাকায় ২০১২ সালের ১২ জুলাই রাউন্ডটেবিলের আয়োজন করে এবং সেখানে জোরালোভাবে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এই আলোচনা থেকে বিকল্প অর্থ সংস্থানে সরকারের নিকট একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ উপস্থাপন করে। সেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আইডিইবির সুপারিশ বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হওয়ায় সরকারপ্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা কৃতজ্ঞ। 
আইডিইবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ন্যায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পুরো দেশবাসীর মধ্যে যে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছে আগামী দিনে সেই প্রত্যয়ে ভর করে দেশে আরও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এই অর্থের মূল যোগানদাতা হিসেবে প্রবাসী ও তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মূল্যায়ন করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আরও বেশি দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিশালী রিজার্ভ গড়ে উঠতে আরও সহায়ক হবে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এবং এর সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন আমাদের জন্য গৌরববোধ ও আভিজাত্যের অনন্য অহংকার। বিশ্ব বাংলাদেশকে যে চোখে দেখত এখন সেই চোখে দেখার অবকাশ নেই। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতার দেশ। প্রতিটি অঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করে চলেছে বাংলাদেশ। এখন উন্নয়ন টেকসই করার বিষয়ে আমাদের অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টির বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাতে যেন কোনোভাবেই পরিবেশ-প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব না পড়ে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। কোনো উন্নয়ন যেন পরিবেশগত সমস্যার উদ্রেক না করে এবং দূষণের সমস্যাগুলো বৃদ্ধি না পায় সেদিকে মনোযোগ রাখা বাঞ্ছনীয়। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের যে বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেটি যেন আমাদের মূল্যবান কৃষিজমি ও এর উর্বরতাকে গ্রাস না করে সে বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে সরকারকে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলসহ সচেতন দেশবাসীকে মনে রাখতে হবে- দেশে কৃষি উপযোগী জমি রয়েছে মাত্র ৮৮ লাখ হেক্টর। প্রতিবছর বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ১ লাখ হেক্টর মূল্যবান কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় নব্য ধনিক বেনিয়ারা প্রমোদ বিলাসের ভ্রান্ত ধারণা থেকে শত শত একর মূল্যবান কৃষিজমি নিয়ে রিসোর্ট নির্মাণ করছে। তাদের এ ধরনের দেশপ্রেমহীন কর্মকাÐের জন্য বিপুল কৃষি জমির ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কৃষিজমি বিনাসী এ ধরনের আত্মঘাতী কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াসহ কৃষিজমি বিনষ্ট করে নির্মিত সব রিসোর্ট ভেঙে ফেলতে হবে।
অতীতে আমরা দেখেছি নগরায়ণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে অপচয় হয়েছে কৃষি জমির। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, আবাসন নির্মাণের মাধ্যমে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যখন শিল্পায়ন হবে তখন পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা না গেলে বাহ্যিক কারণে নেতিবাচক দূষণ ঘটতে পারে। কারখানার বর্জ্য কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ করতে পারে। অতীতে দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা গেছে- উৎপাদন ঘনিষ্ঠরা অনেক ক্ষেত্রেই আইন মানতে চায় না। ফলে শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে বিপজ্জনক প্রক্রিয়ায় বর্জ্যরে ডাম্পিং ঘটতে পারে। একই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে, বিপজ্জনক বর্জ্যরে জন্য কৃষিজ অর্থনীতিতে জমির উর্বরতা হ্রাস পেতে পারে, বনজসম্পদ উজাড় হতে পারে, ইকো ব্যবস্থাপনা এবং জৈববৈচিত্র্য হ্রাস পেতে পারে এবং যেসব সম্পদ পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্ভব নয় সেগুলো সীমাবদ্ধ সম্পদে রূপান্তর হতে পারে। এ কারণেই পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে কলকারখানা স্থাপনকালে যেন শিল্পপতি এবং উদ্যোক্তারা সবুজ শিল্পায়নের পথ বেছে নেয় সেদিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে এখন থেকেই কর্মপদ্ধতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতিগতভাবে যে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রত্যয়ে ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মমর্যাদায় টিকে থাকবে। 
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমরা দেখাতে পারলেও প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশের ওপর। যে কারণে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে আরও ব্যাপক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি জ্ঞানে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমাদের প্রকৌশলীদের বড় বড় মেগা প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কারিগরি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি মেগা প্রকল্প পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণেও জনসম্পদ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নচেৎ, ধার করা প্রকৌশল ও কারিগরি জনবল আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের সময়সীমাকে প্রলম্বিত করবে। তাই জাতির এই আনন্দঘন মুহ‚র্তটি যেন সমৃদ্ধ আগামীর নির্মাণের প্রত্যয়কে উৎসাহিত করেÑ সেটাই প্রত্যাশা।

 লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি