বড় ধরনের ভূমিকম্পের  ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৪

আলতাব হোসেন

সম্প্রতি দেশের ভিভিন্ন অঞ্চলে ঘন ঘন ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। এর ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে। এতে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার অদূরে মধুপুর ও সিলেটের ফাটল খুব বিপজ্জনক। এসব জায়গায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়। এই হিসেবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, হতে পারে তুরস্কের চেয়ে ভয়াবহ।

ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, চলতি মাসে তিন দফায় ভূমিকম্প নতুন উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে ও পরে এ ধরনের ছোট ছোট (প্রি-শক বা আফটার শক) হয়। বড় মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেট বা ময়মনসিংহ হলেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকায়। পরিস্থিতি পযবেক্ষণ করে আর্থ অবজারভেটরি সেন্টার বলছে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এ কারণে দেশে ভূ-গর্ভে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চয় করছে। ধরণা করা হচ্ছে জমানো শক্তি সাড়ে ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে রূপ নিতে পারে। 

তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন রাজধানীকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। হাজার হাজার ভবন ধসে পড়বে। এতে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তুরস্কের মতো বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশেও চোখ রাঙাচ্ছে। বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।৷ সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।

রোববার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ৪ দশমিক ২ বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প গবেষণাগারের কর্মকর্তা রোবায়েত কবীর। এ নিয়ে এ মাসে তিনবার দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) সিলেট এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত। এছাড়া ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামের কাছাড় এলাকা। গত আগস্ট মাসে দুই দফায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে একটি অনুভূত হয় ২৯ আগস্ট। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। এর আগে ১৪ আগস্ট আরেকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর সফিকুল ইসলাম বলেন, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ। 
বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, তাতে যে কোনো সময় রিখটার স্কেলে ৭ এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। এর ফলে নেমে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। ভূমিকম্প সাধারণত সংঘটিত হয় ভূতাত্ত্বিক প্লেটের বাউন্ডারি কিংবা ফাটলরেখা বরাবর। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে ভারত ও বার্মিজ খন্ডিত প্লেটের বাউন্ডারি এবং দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করার মতো রয়েছে তিনটি ফাটলরেখা। দেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ মধুপুর ফাটলরেখা। ভারতের উত্তর-পূর্ব মেঘালয় অঞ্চল ও বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ সীমান্ত অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ফাটলরেখা। আবার দেশের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার লম্বা পূর্বাঞ্চলীয় সুদীর্ঘ ফাটলরেখা, যা আন্দামান নিকোবর থেকে শুরু করে হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।

অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, এ অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের চেয়ে বড় মাত্রার যেমন- ৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০ থেকে ২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনো ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়তো আরও ১০ থেকে ২০ বছর পর হতে পারে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২ থেকে ৩টি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা রয়েছে। 

বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে। এরকম ১৫০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন আঘাত হানবে কেউ জানে না। সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এছাড়াও যে কোনো সময় হতে পারে।

ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মতো উৎস রয়েছে। সিলেট থেকে চট্টগ্রাম এবং মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারে যে পার্বত্য এলাকা রয়েছে সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চলটি লকড হয়ে গেছে অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে। সুনামগঞ্জের হাওড় রয়েছে সেটি দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটা রেখা দেখা যাচ্ছে এই এলাকাটা হচ্ছে দু’টি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল। আর এই দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্ব দিকেরটা হচ্ছে বার্মা প্লেট। আর পশ্চিমেরটা হচ্ছে ইন্ডিয়া প্লেট। হাজার বছরের শক্তি এখানে জমা হয়ে আছে। এই শক্তি যে কোনো দিন বের হয়ে আসবে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোন ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের এখনো ধারণা নেই।

পরিবেশবিদ ডক্টর আবুল কাশেম বলেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বেশির ভাগ ভবন মালিকই তা মানছেন না। এ বিষয়ে আইন হওয়ার প্রায় ২০ বছর পরও এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং ভূমিকম্পে ক্ষতির আশঙ্কা।

তিনি আরও বলেন, পূর্বাভাসবিহীন ভূমিকম্পের মতো একটি বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় মহড়ার কোনো বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক, যুবক, শিক্ষক, পাড়া মহল্লার ক্লাবসহ সবাইকে নিয়ে সমন্বিত মহড়া দিতে হবে। ক্ষতি কমাতে বারবার মহড়া দেওয়া উচিত। এতে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়বে এবং সবাই জানবে ভূমিকম্পের সময় তার কী করণীয়। মহড়ার মাধ্যমে সচেতনতা ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।

যাযাদি/ এস