ঋতুকন্যা হেমন্তের মিষ্টি দিন এলো প্রকৃতিতে

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৪৭

বীরেন মুখার্জী

আশ্বিনের মন্দমধুর হাওয়া, কাশগুচ্ছ আর সাদা মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে শরৎ পেরিয়ে প্রকৃতিতে হেমন্তকাল চলে এসেছে নীরবে। এখন ভোর আর সন্ধ্যায় গ্রামাঞ্চলে দেখা মিলছে হালকা কুয়াশার। পঞ্জিকার পাতায় যতই আজ দিন-তারিখ দিয়ে হেমন্ত শুরু হোক না কেন, প্রকৃতিতে ঋতুটি এসে গেছে এক সপ্তাহ কিংবা এর একটু আগেই। গ্রামাঞ্চলে দেখা মিলছে কুয়াশামাখা ভোরের। দুপুরের পর রোদের তীব্রতা কমে হালকা শীতের পরশ। বিকেলগুলো যেন স্বল্পায়ু। সন্ধ্যা নামতেই শীত শীত মিষ্টি অনুভূতি।

‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার, -চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,/ তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান...।’ বাংলার হেমন্তকাল ধূসর পাণ্ডুলিপির কবি জীবনানন্দ দাশেরই। ভোরের কাক হয়ে কিংবা শঙ্খচিল, শালিকের বেশে যিনি এই কার্তিকের নবান্নের দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন কবিতায়। সেই কার্তিকের আজ প্রথম দিন। আজ পয়লা কার্তিক, হেমন্তের শুরু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ- এই দুই মাস নিয়ে চিরায়ত হেমন্তকাল। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে ধীর পায়ে প্রকৃতিতে আসে হেমন্ত।

এত কিছুর পরও শরৎ ও শীতের মাঝে এই হেমন্ত ঋতু কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোজগতে কম ঠাঁই পেয়েছে? কবির কথায়, ‘আজি এল হেমন্তের দিন/ কুহেলিবিলীন, ভূষণবিহীন’। অর্থাৎ হেমন্তের না আছে শীতের কুহেলি বা কুয়াশা, না আছে শরতের নীলাকাশ-সাদা মেঘের ভূষণ। বলা হয়ে থাকে, বাংলায় শরৎ আসে নববধূর মতো। আর হেমন্ত আসতে আসতে সেই নববধূ পুরোপুরি সেজে ওঠেন ধানের রঙে।

নতুন ঋতুর আগমনে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। হেমন্তের শুরু কার্তিক মাসে বাংলার আদিগন্ত মাঠজুড়ে সবুজ ধানের সমারোহ। মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির জমতে শুরু করে ঘাসের ডগায়। দিনে তাতানো রোদ থাকলেও গোধূলিতে কুয়াশার আবছা চাদরে ঢেকে যায় প্রকৃতি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেমন ‘শিশিরের শব্দের মতো’ সন্ধ্যা নামে। হেমন্তকে অনেকেই ঋতুকন্যা বলেন, আবার অনেকে বলেন ‘রিক্ততার ঋতু’। 

প্রকৃতিতে ঋতুকন্যা হেমন্ত এলে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরতের প্রকৃতির রূপ ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। সূর্য ধীরে ধীরে তাপ বিকিরণ প্রত্যাহার করে নেয়। শীতল বাতাসে সবুজ বনানী ক্রমে হলুদাভ হয়ে উঠতে থাকে। শুরু হয় পাতা ঝরার খেলা। হেমন্তের শেষভাগে জেঁকে বসে শীত। ফলে হেমন্তকে শীতের বাহনও বলা যায়। তবে হেমন্তের ঝরাপাতার শব্দ ও কুয়াশাসিক্ত হলুদ প্রকৃতি প্রাণিত করে কবি-সাহিত্যিকদের। হেমন্ত প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনায় মগ্ন হন তারা।

হেমন্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/ জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/ শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/ রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার/ স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ হেমন্তকে চেনা যায় তার ‘স্বর্ণশ্যাম’ রঙের বিভা এবং ভোরের শিশিরে। খুব ভোরের শীতল বাতাসে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু যখন অপার্থিব দৃশ্যমালা তৈরি করে তখন হেমন্তের প্রকৃত রূপ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘লিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/ নিস্তব্ধ ছিলাম বসে;/ শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খসে;/ নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/ উড়ে গেল কুয়াশায়, কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরও...।’ 
বলাই বাহুল্য, হেমন্ত জীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য সময় হয়ে ওঠে। হেমন্তের প্রথম মাসটির এক রূপ। পরেরটির অন্য। একসময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এই সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। 

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আভাস পাওয়া যায় মন্দাক্রান্ত কার্তিকের। তিনি লিখেছেন, ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/ কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’ তবে হেমন্ত- প্রকৃতি মানুষের ভাগ্যেরও পরিবর্তন নিয়ে আসে। বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য আমন ধান কাটার মৌসুম শুরু হয় হেমন্তের শেষভাগে। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। কৃষকের বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকাতে ব্যস্ত। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। দিনে দিনে বদলাচ্ছে সেই হিসাব-নিকাশ। এখন আগের সেই অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয়-রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই পুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শিষ। 

হেমন্তকাল ফসলের ঋতু। প্রথম মাস কার্তিক একসময় বাংলার ঘরে ঘরে অভাবের মাস হিসেবে পরিচিত ছিল। কার্তিকের সেই মঙ্গার কাল মানুষ আগেই পার করেছেন। অগ্রহায়ণ পুরোপুরি ধান কাটার মাস। মাঠে, কৃষকের বাড়িতে নতুন ধানের ঘ্রাণ। নবান্ন উৎসবের সূচনা হয় এই ঋতুতে। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পুরোভাগে থাকা এই নবান্ন উৎসব অনাদিকাল থেকে বাঙালির জীবন অধিকার করে আছে। 

জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম গেয়েছেন, ‘উত্তরীয় লুটায় আমার-/ ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়।/ আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে/ নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়।/ ভাটির শীর্ণা নদীর কূলে/ আমার রবি-ফসল দুলে,/ নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর/ চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়।’

তবে প্রকৃতিতে সব সময় সবকিছুই বইয়ের পাতার মতো হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাল্টে গেছে ঋতু পরিবর্তনের আবহমানকালের পাণ্ডুলিপি।

যাযাদি/ এস