সহযোগীদের খবর

এবার তৃণমূলে হাত বিএনপির

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৩

যাযাদি ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত

কালবেলা

এবার তৃণমূলে হাত বিএনপির

শফিকুল ইসলাম

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। মাঠপর্যায়ে দল পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন কমিটি। জেলায় জেলায় সম্মেলন চলছে। সব জেলায় সম্মেলন শেষে জাতীয় পর্যায়ে সম্মেলনের আশাও করছে দলটি। এরই মধ্যে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে দলকে শক্তিশালী করার জন্য মূল দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। মূলত ৬০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তৃণমূলের কমিটি পুনর্গঠন করতে গত বছরের ২৫ নভেম্বর বেশ কয়েকটি টিম গঠন করেছে বিএনপি। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তৃণমূলের সব কমিটি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে দলটি। সেই সঙ্গে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বস্তরের জনশক্তিকে সক্রিয় করতে সদস্যপদ নবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মাধ্যমে দলের জন্য বৈধ তহবিল সংগ্রহ ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো এবং দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরাতে চায় দলটির হাইকমান্ড।

জানা গেছে, গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়নের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সদস্যপদ নবায়ন কার্যক্রম শেষ হলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিএনপি নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযানে নামবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের দোসর কেউ যাতে দলে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে নেতাকর্মীরা সতর্ক রয়েছেন। জেলা উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনসহ দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমগুলো সরাসরি তদারক করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি তার পরামর্শ নিচ্ছেন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে বিএনপি অন্তত কুড়িটি সাংগঠনিক জেলা শাখায় কমিটি হালনাগাদ করেছে। গত রোববার এক দিনেই ১৩ জেলায় নতুন আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। এসব কমিটিতে যেমন ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তেমনি কিছু পুরোনো মুখও স্থান পেয়েছে। ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাদের বিভিন্ন কমিটির শীর্ষ পদসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে, যা পার্টিতে ‘চমক’ হিসেবে বলছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। তবে নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে আগের কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই কোনো কোনো জেলায় কমিটি গঠনের অভিযোগও উঠেছে। দলের ভেতরে আধিপত্য বিস্তার ও কমিটি গঠনকে ঘিরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেককে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে। আলাপকালে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা কালবেলাকে বলেন, ‘তারা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চান, দেখাতে চান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিএনপির সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করার পরিকল্পনাও আছে। আগামীতে যারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পদে থাকবেন, তাদের জেলা বা তৃণমূলের নেতৃত্বে না রাখার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ কেন্দ্র ও জেলার নেতৃত্ব হবে আলাদা। সেজন্য বর্তমান বাস্তবতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে মাথায় রেখে অপেক্ষাকৃত তরুণ, উদ্যমী, মেধাবী সাবেক ছাত্র নেতাদের দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হচ্ছে। কমিটি গঠন ও নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মেধা, পরিশ্রমের পাশাপাশি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় আন্দোলনে ভূমিকা ও ত্যাগের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। যাতে করে তরুণ নেতৃত্ব দেশের নতুন প্রজন্মমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারে। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে তাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জায়গা হবে বলে এরই মধ্যে বিএনপির হাইকমান্ড ইঙ্গিত দিয়েছে।

তৃণমূলে মজবুত সংগঠন বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘দেশ ও জাতি গঠনে তরুণদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের ভূমিকা অতুলনীয়। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের এগিয়ে আসার পথ খোলা রাখতে হবে। তাদের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। তরুণদের মধ্যে যারা দক্ষ, যোগ্য, ত্যাগী এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে, তারা এরই মধ্যে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ কারণে তাদের সুযোগটা আরও বাড়ানো উচিত। অবশ্য দল পরিচালনায় নবীন-প্রবীণের সমন্বয় জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ পদে তরুণদের এগিয়ে নেওয়ার কারণ হলো যাতে তাদের কাছ থেকে ভালো সেবা পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত তরুণরা যেহেতু বেশি পরিশ্রম করতে পারবেন, দীর্ঘ সময় নেতৃত্বে টিকে থাকতে পারবেন, সে কারণে সাবেক ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে আনা হচ্ছে।’

নির্বাচন সামনে রেখে সাজানো হচ্ছে মাঠ জানা গেছে, ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর বিএনপির ওপর হামলা, মামলা, গুম-খুন, চাঁদাবাজি, হয়রানি, গায়েবি মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নসহ নানামুখী ক্র্যাকডাউন শুরু হয়। নির্যাতন এড়াতে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী ছিলেন বছরের পর বছর ফেরারি জীবনে; এমনকি অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বহু ত্যাগী নেতাকর্মী নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এসে রিকশা-ভ্যান চালিয়েছেন, কুলি-মজুরের কাজ কিংবা উবার পাঠাও চালিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। অনেকে দিনের পর দিন মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে খোলা আকাশের নিচে, বনে জঙ্গলে রাত যাপন করেছেন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে দিন পার করেছেন। অনেকে দিনের পর দিন শত শত মামলায় হাজিরা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তারা ভয়হীন নিরাপদ জীবনে ফিরেছেন। এমনটাই মনে করেন দলের নেতারা। তারা জানান, নির্যাতন সইতে না পেরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ তৃণমূলের নেতারা সাজানো মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় কারাবন্দি ছিলেন। তারা অনেকেই মা-বাবা এমনকি স্বজনের মুখটিও শেষ পর্যন্ত দেখতে পারেননি। এখন বিদেশে থাকা নেতাদেরও প্রায় সবাই দেশে ফিরেছেন। তারা দলকে পুনর্গঠনে কাজ করছেন।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দেয় বিএনপির হাইকমান্ড। ওই সময় সরকার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বেশি মনোযোগী হওয়ায় তৃণমূল সাজানোর কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি দলনি। তাছাড়া হামলা ও মামলায় অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে ও কারাগারে থাকায় কমিটিগুলো করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী আজ্ঞাবহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জিঘাংসার কারণে তৃণমূল গোছানো সম্ভব হয়নি। এখন তাদের হাতে অবারিত সুযোগ এসেছে। এখন বিভিন্ন জেলা ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়েছে বিএনপি।

দলীয় সূত্র জানায়, সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক জেলা শাখা কমিটি (মহানগরসহ) ৮২টি। ২০১৯ সালে বেশিরভাগ শাখায় আংশিক এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমানে যার অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে দীর্ঘ এই সময়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি হালনাগাদও করা হয়েছে।

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিলের মাধ্যমে সারা দেশে তৃণমূলের নতুন নেতৃত্ব বাছাই করতে চায় বিএনপি। সেই লক্ষ্যে গত বছরের ২৫ নভেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ৯০ দিনের মধ্যে সব কমিটি পুনর্গঠন করার সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। ঢাকা বাদে দলটির নয় সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বে দেওয়া হয় নয় জন কেন্দ্রীয় নেতাকে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী তৃণমূলের কমিটি গঠন শেষ করে সাংগঠনিক জেলা কমিটির নেতৃত্ব ঠিক হবে সম্মেলন বা কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে। সে হিসাবে বেঁধে দেওয়া সময়ের দুই মাস ইতোমধ্যে পেরিয়েছে।

বিগত ৫ আগস্টের পর কিছু বিতর্কিত অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গসহযোগী সংগঠনের একাধিক জেলা, উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেগুলোও পুনর্গঠন করা হচ্ছে।

এদিকে সর্বশেষ গত রোববার যে ১৩ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম, মাগুরা, নাটোর, বান্দরবান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা। এর মধ্যে আফরোজা খান রীতাকে আহ্বায়ক করে মানিকগঞ্জ জেলার সাত সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি; মিজানুর রহমান সিনহাকে আহ্বায়ক ও মহিউদ্দিন আহমেদকে সদস্য সচিব করে মুন্সীগঞ্জ জেলা কমিটি; মামুন মাহমুদকে আহ্বায়ক করে নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচ সদস্যের কমিটি; ফজলুল হক মিলনকে আহ্বায়ক করে গাজীপুর জেলার তিন সদস্যের কমিটি; মাহবুব আলমগীর আলোকে আহ্বায়ক ও হারুনুর রশিদকে সদস্য সচিব করে নোয়াখালী জেলার পাঁচ সদস্যের কমিটি এবং জাকারিয়া তাহের সুমনকে আহ্বায়ক ও আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিমকে সদস্যসচিব করে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে আহ্বায়ক করে ১৮ সদস্যের সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুত কমিটি করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৪ নভেম্বর দশটি জেলা ও মহানগরে পূর্ণাঙ্গ ও আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। তার মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম মহানগর, বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এবং সিলেট মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়। একই দিনে মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুষ্টিয়া, ময়ময়নসিংহ দক্ষিণ এবং শেরপুর জেলা বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদিত হয়েছে। পরে সেগুলো আংশিক পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। সদ্য ঘোষিত বিএনপির সাংগঠনিক জেলা কমিটি ও জেলার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেগুলোতে ছাত্রদল ও যুবদল থেকে নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের মতে, ‘এসব কমিটি গঠনের পেছনে জাতীয় কাউন্সিল ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেরও যোগসূত্র রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব ভালো ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে তাদেরই হয়তো বিভিন্ন আসনে (নিজ এলাকায়) প্রার্থী করা হবে; এমন চিন্তাও রয়েছে। তবে এসব কমিটিতে এমন কয়েকজন নেতাও পদ পেয়েছেন, যারা আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন না-এমন অভিযোগও উঠেছে। এসব নিয়ে তৃণমূলের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

কদর বেড়েছে সাবেক ছাত্র নেতাদের গত রোববার ঘোষিত ১৩টি জেলার নতুন কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘প্রায় সব কমিটিতেই ছাত্রদল ও যুবদলের সাবেক নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার নবঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক রহমতউল্লাহ পলাশ ছিলেন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটির সদস্য। সদস্য সচিব আবু জাহিদ ডাবলু জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি। এ ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান হাদী, তাজকিন আহমেদ চিশতী ও আখতারুল ইসলাম ছাত্রদলের সাবেক নেতা। মেহেরপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাভেদ মাসুদ মিল্টন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা ছিলেন। সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদারবক্স হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যুগ্ম আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম মেহেরপুর কলেজ ও অধ্যাপক ফয়েজ মোহাম্মদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতা ছিলেন।

নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ স্বেচ্ছাসেবক দলের জেলার শীর্ষ পদে ছিলেন। যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান চৌধুরী বাবুল, মিজানুর রহমান ডিউক, মোস্তাফিজুর রহমান শাহীন ও সাইফুল ইসলাম আফতাবও ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। বান্দরবান জেলা বিএনপির সদস্য সচিব জাবেদ রেজাও ছাত্রদল থেকে উঠে আসা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লিয়াকত হোসেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য এসএ জিন্নাহ কবির, আতাউর রহমান আতা, অ্যাডভোকেট আ ফ ম নুরতাজ আলম বাহার ও সত্যেন কান্ত পণ্ডিত ভজন যুবদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট আজাদ হোসেন খানের ছাত্রদল থেকে রাজনীতি শুরু।

এদিকে মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে মিজানুর রহমান সিনহাকে। তাকে এই পদ দেওয়া নিয়ে জেলার নেতাকর্মীদের একটি অংশ খুশি হলেও অন্য একটি অংশ নাখোশ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মিজানুর রহমান সিনহা ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘পদত্যাগ করলে আবার কীভাবে জেলার শীর্ষ পদে পদায়ন হয়—এ বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। নবীন-প্রবীণের সমন্বয় করে কমিটি করা হয়েছে। এটি ভালো দিক।’ এই কমিটির সদস্য সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ ও সদস্য আব্দুল বাতেন শামীমও যুবদল থেকে উঠে আসা। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মামুন মাহমুদের ছাত্রদল থেকে রাজনীতি শুরু। প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তাফিজুর রহমান দীপু ভূঁইয়া যুবদল ও যুগ্ম আহ্বায়ক মাশেকুল ইসলাম রাজিব ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতা।

গাজীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফজলুল হক মিলন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। বিগত কমিটিতেও তিনি সভাপতি ছিলেন। মাগুরা জেলার বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিব কিশোর, খান হাসান ইমাম সুজা একসময় জেলা যুবদলের শীর্ষ পদে ছিলেন। এ ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুকুজ্জামান ফারুক, আলমগীর হোসেন, শাহেদ হাসান টগর ও পিকুল খান ছাত্রদলের জেলা শাখার শীর্ষ পদে ছিলেন। নোয়াখালী জেলা কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব আলমগীর আলো ও সদস্য সচিব হারুনুর রশীদেরও রাজনীতির হাতেখড়ি ছাত্রদল দিয়ে। কমিটি গঠনে নোয়াখালী জেলার সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের কোনো মতামত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মোহাম্মদ শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হয়ে বর্তমানে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম জেলা কমিটিতেও একাধিক নেতা রয়েছেন যাদের রাজনীতির শুরু ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে।

সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতেও ছাত্রদলের সাবেকরা এদিকে সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন করার জন্য প্রস্তুতি কমিটিতেও সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে। বরিশাল মহানগরের আহ্বায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি হাসান মামুন। বরিশাল দক্ষিণ ও ঝালকাঠি জেলার দায়িত্বে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হায়দার আলী লেলিন ও বরিশাল উত্তর জেলার দায়িত্বে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মো. দুলাল হোসেন। পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাবেক ছাত্রদল নেতা কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপুকে।

কমিটি নিয়ে বিভিন্ন জেলায় ক্ষোভ সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ-বিভক্তি তৈরি হয়েছে। কুষ্টিয়ায় এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলেছে। কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বিএনপির কতিপয় নেতার চাঁদাবাজির কারণে কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে চালের দাম বাড়ছে বলেও অভিযোগ করেছেন দলের একাংশের নেতারা। আর মেহেরপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে আওয়ামী লীগের দোসরদের রাখার অভিযোগ তুলে কমিটি পুনর্বিবেচনার দাবিতে গণমিছিল করেছে সদর উপজেলা বিএনপি। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিএনপির একটি পক্ষের হামলায় সেলিম ভূঁইয়া নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চারটি ইউনিয়নের সম্মেলন স্থগিতের প্রতিবাদে হরতাল ডাকে স্থানীয় বিএনপি। নাটোরে জেলা বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করে গণপদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন পদবঞ্চিত নেতারা। ঝালকাঠি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাবেক ও বর্তমান নেতাদের বিরোধ দেখা দিয়েছে। একইভাবে বরগুনার পাথরঘাটা, বগুড়ার ধুনট, বরগুনার পাথরঘাটা, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়ন বিএনপির সম্মেলন বাতিল চেয়ে একাংশ বিক্ষোভ মিছিল করেছে।

যা বললেন সালাম আজাদ জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, আমরা প্রায় ১৬ বছর এক ধরনের জিঞ্জিরে আবদ্ধ ছিলাম। ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি, যা এতদিন শেখ হাসিনা কেড়ে নিয়েছিল। এখন দেশের মানুষসহ নেতাকর্মীরা মুক্ত। বিএনপির মতো বিরাট রাজনৈতিক দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে এটা স্বাভাবিক। সবাইকে পদ দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে কেউ খুশি, কেউ অখুশি হন। আমি মনে করি একটি বাধাহীন পরিবেশে এবার আমরা ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের চেষ্টা করছি। এতে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে যেমন আরও শক্তিশালী হবে তেমনই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুন্দর নেতৃত্ব তৈরি হবে।

দল শক্তিশালী কাঠামোতে দাঁড়াবে: শিপলু বিএনপির চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু কালবেলাকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলকে একটি শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করতে চান। সেই লক্ষ্যে সারা দেশে দ্রুত গতিতে দল পুনর্গঠন করা হচ্ছে। সাবেক ছাত্রনেতাদের বিএনপির নেতৃত্বে আসার বিষয়টি খুবই প্রত্যাশিত এবং ইতিবাচক। অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের সমন্বয়ে কমিটি দিলে দল শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য হয়। কেননা তারা তো রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে দলকে শক্তি জোগাবে। তৃণমূলে নজর দেওয়ায় এবং তৃণমূলে কার্যকর কমিটি গঠন করতে পারলে দল শক্তিশালী কাঠামোতে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন এই নেতা।

প্রথম আলো

'গণহত্যার ঘটনায় তদন্ত চলছে হাসিনাসহ ১০৮ জনের বিরুদ্ধে'

গণহত্যার ঘটনায় তদন্ত চলছে হাসিনাসহ ১০৮ জনের বিরুদ্ধে' প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম এটি। এ খবরে বলা হয়, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১০৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা গেছে ৩৪ জনকে। ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত মামলা (মিস কেস) হয়েছে ১৬টি। এই মামলাগুলোতে আসামির সংখ্যা ১০৮। তবে একটি মামলারও তদন্ত প্রতিবেদন এখনো ট্রাইব্যুনালে জমা হয়নি। এই ১৬ মামলা এখন প্রাক্‌-বিচার পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করলে এসব মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় আড়াই মাস পর ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালে। যদিও এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় সূত্র বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত ৩০০টির মতো অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ যাচাই–বাছাই করে ট্রাইব্যুনালে ১৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলা হয়েছে গুমের ঘটনায়। বাকি ১৩টি মামলা হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। ১৬ মামলার মধ্যে ২টিতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ (একটি মামলায়) আনা হয়েছে। এ মামলায় ১৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি মামলা হয়েছে গুমের অভিযোগে। সেই মামলার শুনানি ১২ ফেব্রুয়ারি।

এখন পর্যন্ত একটি মামলাতেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত বিস্তৃত ও জটিল বিষয়। এই অপরাধ দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছে। ফলে মামলার সাক্ষী ও তথ্য-উপাত্ত বিপুল। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে তদন্ত শেষ করতে যুক্তিসংগত সময় প্রয়োজন। বেশি তাড়াহুড়ো করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে ত্রুটি থাকতে পারে, এতে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দেশবাসীর উচিত হতাশ না হয়ে যুক্তিসংগত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। চলতি মাসের শেষ দিকে কিংবা মার্চের শুরুর দিকে দু-তিনটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।

'এজেন্সির লোভে টিকিট দুর্মূল্য' কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম এটি। এ খবরে বিমানের ভাড়া নিয়ে যে নৈরাজ্য হয় তা তুলে ধরা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, অতি মুনাফালোভী কিছু ট্রাভেল এজেন্টের লোভের মাশুল গুনছে প্রবাসীসহ সাধারণ বিমান যাত্রীরা। এই চক্রের সিন্ডিকেটের কবজায় বিমানের টিকেট বাণিজ্য। তারা এয়ারলাইনসগুলোর টিকেট আগাম ব্লক করে নিজেদের জিম্মায় রেখে পরে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। ফলে বিদেশগামী বিমানের যাত্রীদের স্বাভাবিক ভাড়ার তিন গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা দিয়ে টিকেট কিনতে হচ্ছে। যাত্রী, কর্মী ও ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সংবাদটিতে। জানা যায়, ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার টিকেট তাদের সিন্ডিকেটের কারণে কিনতে হচ্ছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনস ব্যবসায়ী ও দেশীয় কিছু ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারা বিভিন্ন এজেন্সির চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যাত্রীদের কোনো প্রকার পাসপোর্ট, ভিসা ও ভ্রমণ নথিপত্র ছাড়াই শুধু ই-মেইলের মাধ্যমে কিছু এয়ারলাইনসের বিভিন্ন রুটের গ্রুপ সিট বুকিং করে থাকে।

‘আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী’-প্রথম আলো পত্রিকার আরেকটি শিরোনাম এটি। পত্রিকাটিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তথ্য উপদেষ্ঠা নাহিদ ইসলাম এ কথা বলেছেন। প্রথম আলো থেকে তাকে প্রশ্ন করা হয়-এই সরকারের ওপর মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল সিন্ডিকেট করে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হতো, এটা আর হবে না। মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার আসলে কী করছে, মুখের কথায় তো আর স্বস্তি আসে না। এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, এই বাস্তবতা তো আসলে আছে। এটা নিয়ে আমরাও আসলে অনেকটা বিব্রত। মানুষ চেয়েছিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা সামাল দেয়া যাবে...কিন্তু এই সরকার তো আগের সরকারের ধ্বংসাবশেষের ওপর তৈরি হয়েছে। আমরা আমলাতন্ত্র, পুলিশকে যে জায়গায় পেয়েছি...সরকারকে সেই জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা, ষড়যন্ত্র...। আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী। নানা ধরনের শত্রু আছে। যেভাবে চাঁদাবাজি বেড়েছে...মানুষের তো এটাও প্রত্যাশা ছিল যে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে। যে দলগুলো অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের কর্মীরাই তো চাঁদাবাজিতে। সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা তো তাদের পক্ষ থেকেও লাগবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে শুধু গ্রেপ্তার করে বা আইনশৃঙ্খলা দিয়ে তো এটার পরিবর্তন হবে না।

নিচে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-

প্রথম আলো: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা নতুন রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছে। দুজন উপদেষ্টার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ধারণা করা যায়, উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে আপনারা দলে যোগ দিতে যাচ্ছেন...

নাহিদ ইসলাম: উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা এখনো নিইনি। হয়তো আরেকটু সময় লাগবে। আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করছি কোথায় আমাদের ভূমিকাটা সবচেয়ে বেশি হবে— সরকারের ভেতরে নাকি বাইরে, মাঠে। শিক্ষার্থীরা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন, এই সময়ে বা সামনের দিনগুলোর জন্য তাদের সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের ব্যানারে সক্রিয় হয়েছে। তাদের কর্মীরা নিজ নিজ ব্যানারে চলে গেছেন। কিন্তু যাদের কোনো দল নেই, তাদের মধ্যেও একধরনের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা আছে। নেতৃত্ব বা রাষ্ট্র গঠনে তারাও ভূমিকা রাখতে চান। এই শক্তিটাকে সংহত করার জন্য একটা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকেই এ ধরনের একটা আলাপ ছিল। সেই সময় আমরা ভেবেছি রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে সংহত করা প্রয়োজন। আমরা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে এসেছি। আমাদের কিছু অঙ্গীকার আছে। সেটা বাস্তবায়ন করে সরকার ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সেই বিষয়টা এখন পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে।

প্রথম আলো: আপনি কি নতুন দলে কোনো দায়িত্ব নিচ্ছেন?

নাহিদ ইসলাম: সরকার ছাড়ার সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদি সে রকম হয়, তখন...।

প্রথম আলো: দলের নাম বা আত্মপ্রকাশের সময়ের ব্যাপারে কি কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে?

নাহিদ ইসলাম: যতটা জানতে পেরেছি, কোনো নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে দলের আত্মপ্রকাশের বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। ১৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এটা হতে পারে, এমনটাই এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি।

প্রথম আলো: শোনা যাচ্ছে, ছাত্র উপদেষ্টাদের তিনজনের একজন হয়তো প্রথমে নতুন দলে আসবেন, দুজন আপাতত সরকারে থেকে যাবেন।

নাহিদ ইসলাম: হতে পারে।

প্রথম আলো: নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। আপনি নিজেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, মির্জা ফখরুলের দাবির মধ্যে আরেকটি এক-এগারোর ইঙ্গিত দেখেন। এক-এগারোর সরকারের সময় বিএনপির অভিজ্ঞতা তো সুখকর নয়। তাহলে আপনার কেন মনে হলো, বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যে এক-এগারোর ইঙ্গিত আছে?

নাহিদ ইসলাম: বিএনপির মহাসচিব যে অর্থে নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছেন...। এই সরকার তো যথেষ্ট নিরপেক্ষ। সরকার বিএনপির সঙ্গে একধরনের আলোচনার মধ্য দিয়েই বড় সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। রাষ্ট্রপতিকে পরিবর্তনের বিষয়ে ছাত্ররা দাবি জানালেও বিএনপির পক্ষ থেকে যেহেতু সমর্থন ছিল না, ঐকমত্য ছাড়া সরকার এ বিষয়ে এগোয়নি। আমরা এটাও বলেছি, রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিলে আমরা সরকার থেকে বের হয়ে গিয়েই করব। কিন্তু যেভাবে নিরপেক্ষতার কথা বলা হচ্ছে, তাতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে আরেকটা সরকারের পরিকল্পনা বিএনপির আছে কি না বা বিএনপি এটা চায় কি না, সেই প্রশ্ন আসছে। যদি চেয়ে থাকে, সেটা একটা এক-এগারো টাইপের সরকার হবে। আগেরবারের ভুক্তভোগী ছিল বিএনপি। পরে তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে ওই সরকার (এক-এগারোর) আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে গেছে। সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, সেই জায়গা থেকে আমি কথাটা বলেছি। আগেরবারের ভুক্তভোগী হলেও এবারের সুবিধাভোগী তারা (বিএনপি) হতে পারে একটা ‘এক-এগারো’ ধরনের সরকার করলে। অবশ্য বিএনপির মহাসচিব খুব ইনটেনশনালি (উদ্দেশ্যমূলক) এটা বলেছেন বলেও আমি মনে করি না।

প্রথম আলো: এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন যে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিএনপির কথার ‘টোন’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে?

নাহিদ ইসলাম: বিএনপি এর আগেও বলার চেষ্টা করেছে যে এটা অনির্বাচিত সরকার; দ্রুত একটা নির্বাচিত সরকার হতে হবে। আওয়ামী লীগও বলছে, এটা অনির্বাচিত, অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার। বিএনপিও যখন সে ধরনের বক্তব্য দেয়, তখন কিন্তু প্রশ্ন ওঠে সরকারকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী। সেই জায়গায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কিন্তু অনেক ধরনের মিল পাওয়া যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ইস্যু, জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতেও বিএনপি বলতে গেলে ছাত্রদের সঙ্গে অবস্থানটা নেয়নি। এ কারণে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপি যেটা বলার চেষ্টা করছে যে এটা অনির্বাচিত সরকার, এই কথাটা তো ভুল আসলে। এই সরকারের বৈধতা তো নির্বাচন নয়। কারণ, ক্ষমতার পটপরিবর্তন তো নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি, একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানের সমর্থনই তো থাকে। সেটাই আছে এবং একটা অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য এসেছে। এই সরকারকে অনির্বাচিত, অবৈধ, অসাংবিধানিক বলাটা—আওয়ামী লীগ-বিএনপি তো কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। সেই জায়গা থেকে আমি বলেছি, এটা যাতে আমরা খেয়াল রাখি আওয়ামী লীগ যে দৃষ্টিতে সরকারকে দেখে ও ব্যাখ্যা করে, বিএনপি যদি সেই দৃষ্টিতেই ব্যাখ্যা করা শুরু করে, তাহলে জনগণ তাদের মধ্যে তো পার্থক্য পাবে না।

প্রথম আলো: আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আসতে দেওয়া হবে না, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সম্প্রতি এ বক্তব্য দিয়েছেন। সরকার কি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে?

নাহিদ ইসলাম: মাহফুজ আলম রাজনৈতিক জায়গা থেকে কথাটা বলেছেন। আমরা যাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধিত্ব করছি, আমরাও মনে করি যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বা নৈতিক অধিকার নেই এই দেশে এই (আওয়ামী লীগ) নামে বা এই আদর্শ নিয়ে আর রাজনীতি করার। এটার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কটা (আইনি কাঠামো) কী হবে, এ বিষয়ে সরকার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া এগোলে আদালত থেকে সুপারিশ আসতে পারে, নির্বাচন কমিশন থেকে সুপারিশ আসতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত থাকবে। এসব বিবেচনায় হয়তো আমরা আওয়ামী লীগের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। তার আগে বিচার কার্যক্রমটা প্রধান। বিচারের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারব আওয়ামী লীগের দল হিসেবে অংশগ্রহণ (গণহত্যায়) কতটুকু, দলটির নেতা-কর্মীদের কত অংশ জড়িত এবং কীভাবে অপরাধটা সংঘটিত করেছিলেন।

প্রথম আলো: জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি এখন সরকারের কাছে কোন পর্যায়ে আছে?

নাহিদ ইসলাম: বিএনপি তাদের খসড়াটা এখনো দেয়নি। তারা বলছে, তারা তৈরি করছে, খুব দ্রুতই দেবে। অন্য অনেক দল তাদের খসড়া পাঠিয়েছে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে অনেক আগে। সরকারের জায়গা থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। এখন এটা মূলত বিএনপির অংশগ্রহণের অপেক্ষায় আছে।

প্রথম আলো: জুলাই অভ্যুত্থানের আহত ও শহীদ পরিবারকে কেন বারবার রাস্তায় নামতে হচ্ছে দাবি আদায়ের জন্য? অনেকেই বলছেন, আহত ও শহীদ পরিবার সরকারের যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে না।

নাহিদ ইসলাম: কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কিছু ক্ষেত্রে ধীরগতি হয়েছে। কিন্তু সরকারের সব ধরনের উদ্যোগ চলমান আছে। শহীদ পরিবারগুলোকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করেছে। সরকারের জায়গা থেকে তাদের (পরিবারপ্রতি) জন্য ৩০ লাখ টাকা করে বাজেট বরাদ্দ হয়েছে, যেটা এই মাস থেকে দেওয়া শুরু হবে ১০ লাখ করে। আহতদের জন্যও একটা বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর শিগগিরই কাজ শুরু করবে। এই অধিদপ্তর সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে তাদের জন্য সারা জীবন কাজ করবে।

প্রথম আলো: তারপরও কিছুদিন পরপরই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে হচ্ছে...

নাহিদ ইসলাম: বিচারের বিষয়টা তাঁদের (শহীদ পরিবার ও আহতরা) খুব ভাবাচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়টাও তাঁদের ভাবাচ্ছে। এখনো যেহেতু পুলিশ পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মী যাঁরা মামলার আসামি, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। পাশাপাশি বিচার না হওয়ার কারণে তাঁদের ভেতরে একধরনের ক্ষোভ ও ট্রমা রয়ে গেছে।

প্রথম আলো: এগুলো তো আপনাদেরই দায়িত্ব। তাঁরা যাতে উদ্বিগ্ন না হন, বিচার যাতে ঠিকমতো হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আপনাদেরই।

নাহিদ ইসলাম: আমরা বারবার তাঁদের সঙ্গে বসছি, কথা বলছি। সামাজিকভাবে তাঁরা চাইছেন জুলাইয়ের স্বীকৃতিটা। জুলাইয়ের ঘটনাগুলো মানুষ আরও বেশি করে মনে রাখবে, তাঁদের সম্মান দেবে, এই প্রত্যাশাও তাঁদের মধ্যে আছে। সেই জায়গা থেকে সামাজিকভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও কথা বলা উচিত, তাঁদের নিয়ে আরও আয়োজন করা উচিত। আমরা যদি জুলাই ঘোষণাপত্রটা দিতে পারতাম, সেখানে শহীদ ও আহতদের একটা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হয়ে যেত। আমি মনে করি, এটা শুধু সরকারের একক ব্যাপার নয়। তাঁরা চাইছেন, তাঁরা পাবলিক মেমোরিতে (জনগণের স্মৃতি) অনেক বেশি করে থাকবেন, তাঁদের ট্রমাটা দূর হবে। দেশের সবারই শহীদ ও আহতদের বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সরকারের জায়গা থেকে উদ্যোগগুলো কিন্তু চলমান আছে। আশা করি, তাঁরা খুব দ্রুতই সেই সুবিধাগুলো পাবেন।

প্রথম আলো: জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারিতে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল নারীরা। কিন্তু আন্দোলনের পর সংস্কার কিংবা পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা-সব জায়গা থেকে তারা কেন ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল? সরকারের কি এখানে কিছু করার নেই?

নাহিদ ইসলাম: এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের একটা বাস্তবতা আছে। তখন জাতি নারীদের অংশগ্রহণকে সেলিব্রেট (স্বাগত) করেছে। কিন্তু রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি মানুষ এখনো ওইভাবে সেলিব্রেট করে না। আপনি দেখবেন, আমাদের যাঁরা নারী আন্দোলনকারী বা সমন্বয়ক আছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা কিন্তু নানা ধরনের ‘বুলিংয়ের’ শিকার হচ্ছেন। আমাদের রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার, মারামারি-হানাহানির সংস্কৃতি আছে, যেটা এখনো যায়নি। সেই জায়গা থেকে পরিবারগুলোর শঙ্কা থাকে। সমাজ তাঁদের নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সেই জায়গা থেকে নারীদের বড় অংশ ঘরে ফিরে গেছে। তারপরও আমি মনে করি তাদের মধ্যে এখনো সেই বিপ্লবী চেতনাটা আছে। তাঁরা আমাদের সঙ্গে নানাভাবে অংশগ্রহণ করতে চায়, যুক্ত থাকতে চায়। আমরাও বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই একটা কর্মসূচি করেছেন জুলাই কন্যাদের নিয়ে, যে নারী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলায় আন্দোলনে ছিলেন। বিদেশে বিভিন্ন লিডারশিপ ও ট্রেনিং প্রোগ্রামে আমরা নারীদের পাঠাচ্ছি। আমরা এমন নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। নারীদের রাজনীতি বা নেতৃত্বে আরও বেশি অংশগ্রহণের জন্য আসলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটা দরকার।

প্রথম আলো: ৫ আগস্টের পরও গণমাধ্যমের ওপর হুমকি-চাপ দেখা গেছে। আপনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করছেন। মুক্ত গণমাধ্যম, ভয়ভীতিমুক্ত গণমাধ্যম—এটা নিয়ে আপনার কী চিন্তা?

নাহিদ ইসলাম: আমার জানামতে, ৫ আগস্টের পর সরকারের সমালোচনা করার কারণে কোনো গণমাধ্যমের ওপর কোনো চাপ তৈরি করা হয়নি। আমরা বলেছি, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠন, মামলার আসামি, ফ্যাসিস্টদের সহযোগী—এদের বিষয়ে যাতে গণমাধ্যমগুলো সতর্ক হয়। পাশাপাশি ভুল তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে যাতে তারা সতর্ক হয়।

গণমাধ্যমের ওপর সরকারের জায়গা থেকে কোনো ধরনের চাপ নেই। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সামাজিক চাপ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সরকার কিন্তু গণমাধ্যমকে সহযোগিতা করেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গ্রুপ আন্দোলন করেছে, সরকারের জায়গা থেকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জায়গা থেকে গণমাধ্যমকে সমর্থন করা হয়েছে। কড়া বার্তা (বিশৃঙ্খলাকারীদের) দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের রাজনৈতিকভাবে অনুসন্ধান করা উচিত, কেন জনগণের একটা অংশ গণমাধ্যমের ওপর ক্ষুব্ধ, গত ১৫ বছরে গণমাধ্যমের কী ভূমিকা ছিল। এই সরকার চায় গণমাধ্যম উন্মুক্ত থাকুক, যৌক্তিকভাবে তারা সমালোচনা করুক এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করুক। কিন্তু ১৫ বছর বিভিন্ন গণমাধ্যম ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা পেশাদারত্ব বাদ দিয়ে যে ধরনের অবস্থান নিয়েছেন, সে বিষয়ে গণমাধ্যমের জায়গা থেকেও কিন্তু কোনো বক্তব্য আসেনি। কোন পরিস্থিতিতে বা কেন তারা সংবাদ প্রচার করতে পারেনি, কোন ধরনের চাপে তারা ছিল, গণমাধ্যমগুলোর জায়গা থেকেও আসলে এই বক্তব্যগুলো আসা প্রয়োজন। আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সবাই মুক্তভাবে সরকারের সমালোচনা করুক। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা সমালোচনাগুলোকে ‘অ্যাড্রেস’ (বিবেচনায় নেওয়া) করি। সেই অনুযায়ী আমরা আমাদের অনেক নীতি পরিবর্তন করেছি, সামনেও করব।

প্রথম আলো: গণ-অভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে এখন নানা রকম দূরত্ব ও বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। ছাত্ররা কোনো একটা ইস্যুতে এগোলেই দেখা যায় একটা বিরোধিতা তৈরি হয়। অভ্যুত্থানে কার কতটুকু অংশীদারত্ব, সেটা নিয়েও রাজনৈতিকভাবে বিতর্ক তৈরি হলো।

নাহিদ ইসলাম: অভ্যুত্থানের পর আমরা নিজেদের অনেক দলীয় স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ইত্যাদিতে ঢুকে গেছি। এটার কারণে অনেক বিষয়ে আমরা এক থাকতে পারিনি। শুধু তো রাজনৈতিক দল নয়, এই যে এত এত আন্দোলন হচ্ছে, সবাই নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের আন্দোলন করছে। আমাদের তো এখন জাতীয় স্বার্থ নিয়ে সবার এক হয়ে কাজ করা উচিত ছিল। সেই ঐক্যটাও দেখা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তেই নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করে নিতে চাইছে। তারপরও আমি মনে করি না যে ঐক্য পুরোপুরি বিনষ্ট হয়েছে। ভিন্নমত তৈরি হচ্ছে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হচ্ছে। আমাদের আগের যে ট্র্যাডিশন (ঐতিহ্য), একেবারে বিরোধাত্মকভাবে প্রতিহিংসা, সেই জায়গায় আমরা যাচ্ছি না এখনো। সংস্কারের জায়গায় আমাদের কতটুকু ঐকমত্য হচ্ছে, সেটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হবে ঐক্য আসলে কতটুকু আছে আর কতটুকু নেই।

প্রথম আলো: সংস্কার না নির্বাচন-রাজনীতিতে একটা মুখোমুখি অবস্থা তৈরি হচ্ছে।

নাহিদ ইসলাম: সংস্কার আর নির্বাচনকে আমরা তো আলাদা করে দেখি না; বরং নির্বাচনকে প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) দিয়েই সংস্কার কমিশনগুলো কাজ করছে। যে ছয়টা সংস্কার কমিশনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এগুলো কিন্তু শাসনতান্ত্রিক। বাকি সংস্কারগুলো জনস্বার্থমূলক। সেগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু নির্বাচন ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে ছয়টা সংস্কার কমিশন হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত বিএনপি ও জামায়াত, তাদের একটা রাজনৈতিক কৌশলের জায়গা থেকে নির্বাচনের কথা বলছে। নির্বাচনের কথা বলা ছাড়া এই মুহূর্তে বিএনপির কোনো রাজনীতিও নেই আসলে। তারা যে সংস্কারের কথা বলছে, সেই সংস্কার তো সরকার এই সময়েই করতে আগ্রহী ও উদ্যোগী। তবু তারা একটা চাপ তৈরি করছে। এটাকে আমরা খুব একটা নেতিবাচকভাবে দেখি না। কিন্তু আমরা তাদের কাছ থেকে সময় চাইছি এবং ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, আমরা যদি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করে কোনো দলের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিই, তাদের জন্যই সরকার চালানো কঠিন হবে। মানুষের প্রত্যাশা যদি পূরণ না হয়, পরিবর্তন যদি না দেখে, মানুষের সেই ক্ষোভ কিন্তু যাবে না।

প্রথম আলো: গণ-অভ্যুত্থানের সরকারের ওপর মানুষের ব্যাপক প্রত্যাশা। গত ছয় মাসে সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন আপনারা? আপনি ১০-এর মধ্যে কত দেবেন?

নাহিদ ইসলাম: আমি ৫০ শতাংশের কিছু কম দেব। সরকারের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছাটা সম্পূর্ণভাবে আছে। যদি রাজনৈতিক দল, অভ্যুত্থানের শক্তি এবং সাধারণ মানুষের জায়গা থেকে আরও সহযোগিতা পাওয়া যায়, আমরা আশা করি সরকার আরও কার্যকর হতে পারবে। মানুষের অনেক প্রত্যাশা থাকতে পারে, পরিবর্তনের স্বাদ সবাই পেতে চায়। কিন্তু আমাদের কাজগুলো করতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে। সংস্কার, বিচার এবং শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন-এই তিনটা আমাদের বেসিক লক্ষ্য। এ ছাড়া আছে রুটিনওয়ার্ক—আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য। এই পাঁচটা জিনিসকে মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি। কিন্তু এর মধ্যে যে নানা আন্দোলন ও দাবিদাওয়া, এ বিষয়গুলো আসলে আমাদের কাজে অনেক ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। নানা আন্দোলন কিন্তু সেভাবে আগের মতো দমন করা হচ্ছে না। আমরা সেটা করতেও চাই না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা হচ্ছে।

সমকাল

রিজার্ভ চুরির ৯ বছর

যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ দেশ এখনও দেয়নি তথ্য

বিদেশি ৭৬, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা

সাহাদাত হোসেন পরশ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘবদ্ধ হ্যাকার গ্রুপ যে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সরিয়েছিল, তা পুরোপুরি উদ্ধারের কোনো কিনারা হয়নি। এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করার পর তদন্তে নামে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ৯ বছর পার হলেও শেষ হয়নি তাদের তদন্ত। এটি ‘ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’ হলেও এখনও সংশ্লিষ্ট পাঁচ দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পায়নি বাংলাদেশ। দেশগুলো হলো– যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া।

চাঞ্চল্যকর এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত শেষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে এসব দেশের সহযোগিতা জরুরি। যদিও এই মামলা ঘিরে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় ভুল ধারায় মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার নামও উঠে আসে। তারা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় মামলাটি তদন্তের এখতিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। এটি দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ। গত ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও সিআইডি থেকে উত্তর মেলেনি। এদিকে এই ঘটনায় বিদেশি ৭৬ নাগরিকের সংশ্লিষ্টতাও মিলেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর পর্যন্ত ১ হাজার ৯২৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক করার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি হ্যাকার গ্রুপটি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘটনার অন্তত ১৩ মাস আগে থেকে হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লেনদেনের কমিউনিকেশন সিস্টেমে ভাইরাস ঢোকানো হয়। এর পাঁচ মাস পর ওই বছরের মে মাসে ফিলিপাইনের ব্যাংকে পাঁচটি হিসাব নম্বর খোলা হয়। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে হ্যাক করে রিজার্ভের অর্থ সরানো হয়।

শুরুতে ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানসহ অনেকে জানলেও তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনা যাতে কেউ জানতে না পারে, সে জন্য তিনি সবাইকে কঠোর নির্দেশনাও দেন। ঘটনাটি ধামাচাপার চেষ্টা চালানো হয়। শুরুর দিকে ফিলিপাইনের বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানালে হ্যাকারদের কাছে পৌঁছানোর আগে এ অর্থ জব্দ করা যেত। এই উদ্যাগ না নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইনের ব্যাংকে কয়েকটি ই-মেইল করে দায়িত্ব সারে। এতে কোনো কাজই হয়নি। হ্যাকিংয়ের আট দিনের মাথায় ফিলিপাইনের ব্যাংক থেকেও টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও বলছে, ঘটনার ৩৯ দিন পর মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলায় চুরি, আইসিটি ও মানি লন্ডারিং ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে মূলত হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে। এজাহারে চুরির কথা বলা না হলেও মামলায় চুরির ধারা দেওয়া হয়। আইনে হ্যাকিংয়ের স্পষ্ট ধারা থাকলেও সেটি মামলায় উল্লেখ করা হয়নি। জড়িতদের সুবিধা দিতেই এই কাজ করা হয়। এ ছাড়া তদন্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দিতে চাপ দেওয়া হয়েছিল। 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হ্যাকাররা সুইফট সিস্টেম ঢোকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৩৬ মিনিটে। রাত ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত তারা সুইফট সিস্টেমে অবস্থান করে। সিআইডি ওই বছরের ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু জিনিসপত্র জব্দ করেন। হ্যাকারসহ বিভিন্ন তথ্য পেতে ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে জাপান, ভারত ও ফিলিপাইন উত্তর দিয়েছে। অন্যরা আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফিলিপাইনের ৪২, শ্রীলঙ্কার আট, চীনের ১৭, ভারতের আট ও জাপানের একজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে মূল হ্যাকার হলেন পার্ক নামে উত্তর কোরিয়ার এক প্রোগ্রামার। তারা চীনে বসে একটি কোম্পানি খুলে হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি ঘটান। হ্যাকারদের অধিকাংশ উত্তর কোরিয়ান বংশোদ্ভূত চীনের নাগরিক। 

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৪.৬১ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার হয়েছে। বাকি ৬৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন এখনও বেহাত। বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইন ব্যাংকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করেছে। মামলায় জিততে পারলে বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। 

জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় যে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সেখানে হ্যাকিংয়ের অনেক তথ্য গায়েবের বিষয় উঠে এসেছে। সেখানে ঘটনাক্রমে অমিল পাওয়া যায়।

আরেকটি সূত্র বলছে, অর্থ সরানোর ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। তাদের সবার বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান নিষেধাজ্ঞার আগেই দেশ ছাড়েন। অন্য যাদের নামে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আছে তারা হলেন–সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ও ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক আনিসউদ্দিন আহমেদ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর কুমার চৌধুরী, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউল করিম, সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা, মামলার বাদী জুবায়ের বিন হুদা, সাবেক উপপরিচালক (সুইফট অপারেটর) জি এম আব্দুল্লাহ সালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন ও একলাস উদ্দিন।

দেশ রূপান্তর

ঐক্য বজায় আছে এখনো

শফিক সাফি

তারিখের হিসাবে আজ ৬ মাস। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার দম্ভের পতনের দিন। ৫ আগস্ট প্রতাপশালী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারত চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।  শত শত প্রাণের বিনিময়ে আর আহতদের কাতরানোর শব্দে যখন বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, তখন ছাত্র-জনতার বিজয়ের পতাকা ওড়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় হলেও রাষ্ট্র সংস্কার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখনো চলমান। গত ছয় মাসে অন্তর্বর্তী সরকার জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ফলপ্রসূ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত বিজয় আসবে তখনই, যখন দেশে আইনের শাসন ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন ঘটবে।

বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলন দানা বেঁধেছিল গত বছর জুলাই মাসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনে সহিংসতার জেরে ওই মাসের মাঝামাঝি সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনের প্রবল ধাক্কায় ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ তিন দিন সরকারবিহীন থাকার নজিরবিহীন ঘটনার পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরে। তার আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় দ্বাদশ সংসদ। প্রশাসনে অস্থিরতা, ‘বঞ্চিত’ পেশাজীবী শ্রমজীবীদের বিক্ষোভের মধ্যে সংস্কারে উদ্যোগী ও ঐক্যের সন্ধানের মধ্য দিয়েই পেরিয়ে গেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এই ছয় মাস।

দিন দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার বিএনপি মনে করে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে দেড় দশক কর্তৃত্ব করা বিগত সরকারের ‘দোসরদের ষড়যন্ত্র’। নির্বাচন যত দেরি হবে, এমন সমস্যা তত বাড়বে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের উদ্যোগে নাগরিকদের নিয়ে গড়া জাতীয় নাগরিক পরিষদ সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে আগে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন চায়। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কবে হবে, দেশের পরবর্তী অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা জানতে আগ্রহী হয়েছে উঠেছে সাধারণ মানুষও, যারা বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি আর বেকারত্বের চক্করে পড়ে নাজেহাল।

‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে অক্টোবর-নভেম্বরে ১০টি কমিশন গঠন করে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও নির্বাচন পাশাপাশি চলার কথা বললেও সংস্কারের জন্য নির্বাচন যাতে ‘বিলম্বিত’ না হয়, সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নজর দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের জন্য দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার না চাইলে চলতি বছরের শেষের দিকে আর সংস্কার শেষ করতে দিলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তবে আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনাসহ যে নানা প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল ছয় মাস পর এসে এর অনেকগুলোতেই তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। তবে সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যেও তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফল আগামী তিন মাসের মধ্যেই পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের পক্ষ থেকে যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে, সেটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও প্রতিবার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। গণঅভ্যুত্থানের এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সরকার। পরে এই তালিকায় নতুন আরও চারটি কমিশন স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যুক্ত করা হয়। গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন জমা পড়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন আজ বুধবার জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার পড়ে, সেগুলোর একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। গত শনিবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজারে চলমান মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে স্বীকার করে বলেছেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে সরকার ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।’

গত ৮ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ঊর্ধ্বমুখী জানিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী ও দিনমজুরদের ওপর চাপ বাড়ছে। মধ্যবিত্তরাও চাপে আছেন। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যেটুকু কমেছে, এটি কিন্তু কম বলা যায় না। মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তিই আছে। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গত মাসে বলেছেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত, নিজে বাজার করে খাই। আমি নিজেও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছি। রিজার্ভের প্রথম চার মাস ভালো অর্জন দেখালেও গেল মাসে কমেছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগের মাসে এসেছিল রেকর্ড ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।’

গত ৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করেন। শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ এক না। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বাংলাদেশের মতো এত খারাপ অবস্থায় যায়নি। বাংলাদেশের মতো হলে তো শ্রীলঙ্কাকে আর খুঁজেই পেতাম না।’

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছিল এ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তাও জানিয়েছে সরকার। ৫ আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। আবার এটাও বাস্তবতা, ৫ আগস্টের পর হামলার শিকার পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাগুলোর সব কটি এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে পুলিশ বাহিনী যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, সেটিও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামায় সরকার। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও জনমনে আতঙ্ক রয়েই গেছে। পল্টন, শান্তিনগর, মগবাজার, মোহাম্মদপুরের একাধিক বাসিন্দা জানান, ‘সন্ধ্যার পর আর কেউ বাইরে থাকতে চান না।’

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, গত পাঁচ মাসে গণপিটুনিসহ মব জাস্টিসের মতো ঘটনায় সারা দেশে অন্তত ৭০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। এ সময় কমপক্ষে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এখনো।

নির্বাচন ও ঘোষণাপত্র ইস্যুতে বিএনপি ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের মুখোমুখি অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।

পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সম্প্রতি এক লেখায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক জানিয়েছেন, ‘সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি সাক্ষাৎকার ঘিরে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী নেতার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির সঙ্গে তাদের মুখোমুখি অবস্থান স্পষ্ট হয়।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাক্ষাৎকারে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন না হলে তারা মানবেন না। জবাবে উপদেষ্টা নাহিদ বলেছেন, বিএনপি আরেকটি ১/১১-এর মতো সরকার চায়। বিএনপি এও বলেছে, নির্বাচিতদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ওই নির্বাচিত সরকার সবাইকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপির এসব প্রস্তাব ছাত্রদের পছন্দ হয়নি। তিনি আরও জানান, বিএনপির বিরুদ্ধে ছাত্র ও জামায়াতপন্থিদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি বাধা দিয়েছে। কিন্তু সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে দেখা যায়নি। গণহত্যার বিচার এই ছয় মাসে কত দূর এগোল? সারা দেশে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ঘুরে বেড়ান, তাদের আটক করে না। ছয় মাস বিচারের জন্য খুব কম সময় নয়। ছাত্ররা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিএনপিকে দোষারোপ করছে বটে, কিন্তু এর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যেহেতু সরকারের মধ্যে ছাত্রদের প্রতিনিধিও আছে।

বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত অক্টোবরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন ও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে। সর্বশেষ ৪ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ব্রিটিশ এমপি রূপা হকের সাক্ষাতের সময়ও প্রধান উপদেষ্টা জানান, ‘মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের জন্য আগামী দুই মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধীদের একধরনের বিপরীতমুখী অবস্থান রয়েছে। ফলে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে সরকার যেমন চাপে থাকবে, আবার ঘোষণা করা হলেও সরকারকে বিরোধিতার মুখে পড়তে হতে পারে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছিলেন, ‘নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।’

গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের আগামী মে-জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সম্ভব। ইতিমধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। এপ্রিল মে মাসের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবে। এ বছরের অক্টোবর নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করায় কোনো সমস্যা দেখছি না। আর চলতি মাসে বা মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে কী কী সংস্কার করা দরকার, তা শেষ করে একটা মতৈক্যের জায়গায় আসতে পারব।’

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ জানান, ‘ছয় মাস ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, আরও এক বছরের বেশি লাগবে, এটার তো কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। অবশ্যই এ বছরের মধ্যে নির্বাচনটা হতে হবে।’ ৩ জানুয়ারি রাজধানীতে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সংস্কারের কথা শব্দচয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, রাজনৈতিক দল ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয় সুনির্দিষ্ট করুন। অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে যেন না পারে, সেজন্য দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।’

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ করছে। তাদের সঙ্গে আছে আন্দোলনের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি। বিভিন্ন জেলায় তাদের নেতারা সভা-সমাবেশ করছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি চাইছে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন দরকার, তারপর নির্বাচন। সংগঠন দুটি বলছে, নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে, তাও আগে চূড়ান্ত করতে হবে। এসবের সঙ্গে ঘোষণাপত্র নিয়ে একাধিক মতানৈক্য রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো ও ছাত্রদের মধ্যে। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা গত মাসে বৈঠকও করেছেন। যার সুরাহা এখনো হয়নি।

সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জুলাই-আগস্টের ‘গণহত্যার’ বিচারের কথাও বলেছে। সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আটশর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মারা গেছে গুলিতে। হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যেই কয়েকশ মামলা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। ‘গণহত্যার’ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে সম্প্রতি অনুরোধও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়। এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তবে কেন সবাইকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ শুরু করা হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।

তবে নিজেদের অর্জনের কথা মোটাদাগে পাঁচটি ক্ষেত্রে হয়েছে বলে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন। সরকার মনে করে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন আনা, দেশের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি বেশখানিকটা উদ্ধার, সংস্কারকাজ পরিচালনায় ব্যাপকভাবে বিদেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়া, সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা এবং বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্পের সংকট ও অস্থিরতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে অর্জন দেখছেন তারা।

সবকিছু ছাপিয়ে গণঅভ্যুত্থানের আগে ছাত্র ও আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য হয়েছিল, তাতে জোর দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ড. ইউনূস। এই ঐক্যকে ধরে রেখেই তিনি এগিয়ে যেতে চান। গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় ঐক্যের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে সেই কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘যখন নিজেরা নিজেরা কাজ করি, তখন একটু দুর্বল মনে করি। আবার যখন সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তখন মনের মধ্যে সাহস বাড়ে, একতাবদ্ধভাবে আছি। আপনাদের (রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের) সঙ্গে দেখা হলে, বসতে পারলে খুব ভালো লাগে, মনে সাহস পাই। ঐক্যের মাধ্যমে করলে সবার মনে সাহস আসবে। সবাই ভাববে আমরা এখনো জেগে আছি। আমরা ভোঁতা হয়ে যাইনি, জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ আছি। আমি যত দিন আছি, একতা নিয়েই থাকব। কাজেই সে পথেই আমাদের চলতে হবে।’

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির চাপে থাকা সরকার আগামীতে দেশকে কোনদিকে বা কোথায় নিয়ে যাবেন, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন একাধিক বিশ্লেষক।

যাযাদি/ এসএম