স্পষ্ট হচ্ছে চিকিৎসা খাতের ভয়ঙ্কর দূরাবস্থার চিত্র

প্রকাশ | ১৭ মে ২০২৫, ১৮:২৩

সাখাওয়াত হোসেন
ছবি : যায়যায়দিন

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্র্ক ক্রমেই খারাপের দিকে এগিয়েছে। বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ভিসা একরকম বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি মেডিক্যাল ভিসাও সীমিত করে আনা হয়েছে। ফলে জটিল রোগে আক্রান্ত যেসব রোগী নিয়মিত ভারতে চিকিৎসা নিতেন, তারা মহাবিপাকে পড়েছেন। থাইল্যান্ড, মালেয়শিয়া, চীন ও সিঙ্গাপুরসহ বেশকিছু দেশ তাদের চিকিৎসা সেবায় এসব রোগীদের আকর্ষন করার চেষ্টা করলেও সেখানে আসা-যাওয়া ও চিকিৎসা খরচ ব্যয়বহুল হওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্তদের পক্ষে সে সুযোগ গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য খাতের যে ভঙ্গুর দশার ভয়ঙ্কর চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অর্থোপেডিক্সসহ যেসব জটিল রোগের চিকিৎসা আগে অল্প খরচে অনায়াসে ভারত থেকে নেওয়া যেতো, সে মানের চিকিৎসা নিতে দেশে কয়েকগুণ বেশি খরচ হচ্ছে। বেশকিছু রোগের সাধারণ চিকিৎসা সরঞ্জামাদিও বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে নেই। নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও এখনো অনেক উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট রয়েছে। এমনকি যেসব চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনুন্নত দেশেও বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই চিকিৎসা চলছে, সেখানে এ দেশের অনেক চিকিৎসক এখনো এসব ইন্সট্রুমেন্টের নামও শোনেননি।

ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসমিয়্যাহ তাবাস্সুম জানান, ২০১৮ সালে তার ডান পায়ের হাড়ে নন-ক্যান্সারাস টিউমার (অস্টিওড অস্টিমা) ধরা পড়ে। দেশের সব সরকারি ও নামিদামি হাসপাতালে ঘুরে তিনি এর উন্নত চিকিৎসা (রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি অ্যাবলেশন) নিতে পারেননি। পরে কোলকাতার হাওড়ার মত অনুন্নত এলাকার একটি হাসপাতাল (নারায়না সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল) থেকে তিনি অনায়াসে স্বল্প খরচে যে চিকিৎসা নিতে সক্ষম হন। 

তাসমিয়্যাহ জানান, দীর্ঘ ৬ বছর পর সম্প্রতি আবারও তিনি একই রোগে আক্রান্ত হলে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে স্বল্প সময়ে সেখানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তিনি আশা করেছিলেন, ২০১৮ সালে দেশে রেডিও ফ্রিক্যুয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরএফএ) মেশিন ও তা পরিচালনার জন্য দক্ষ রেডিওলোজিস্ট না থাকলেও এতোদিনে তা নিশ্চয়ই দেশের বড় হাসপাতালগুলোতে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। অথচ এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি মারাত্মকভাবে হতাশ হয়েছেন। জেনেছেন, শুধু সরকারি হাসপাতালই নয়, এভারকেয়ার, ইউনাইটেড ও স্কয়ারের মত উন্নত হাসপাতালগুলোতেও এতোদিনে পায়ের হাড়ের টিউমার অপসারণে আরএফএ মেশিন ব্যবহারের মত সুযোগ তৈরি হয়নি।

এ ব্যাপারে এভারকেয়ার হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের কো-অর্ডিনেটর ও সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম. আলী এ প্রতিবেদককে জানান, রেডিও ফ্রিক্যুয়েন্সি অ্যাবলেশনের (আরএফএ) মাধ্যমে নন-ক্যান্সারাস বোন টিউমার অস্টিওড অস্টিমার চিকিৎসা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এছাড়া এ চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। বোন টিউমারের ওপেন সার্জারির চেয়ে আরএফএ’র চিকিৎসা খরচও অনেক কম। 

ডা. এম আলী জানান, তিনি নিজে আরএফএর মাধ্যমে অস্টিওড অস্টিমার চিকিৎসা দিতে সক্ষম। এছাড়া এ চিকিৎসা সরঞ্জামের দামও অবহনযোগ্য নয়। এভারকেয়ারের মত উন্নত হাসপাতালগুলোর এ সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য রয়েছে। অথচ নানা জটিলতায় এ হাসপাতালটি দীর্ঘদিনেও আরএফএ মেশিন কেনার সুযোগ পায়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, আরএফএ ও রোবোটিক সার্জারিসহ বিভিন্ন উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য বাংলাদেশের বেশকিছু বেসরকারি হাসপাতালের রয়েছে। সরকারিভাবেও এসব সরঞ্জাম কেনা সম্ভব। অথচ দীর্ঘদিনেও তা কেনা হয়নি। এর নেপথ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দায় রয়েছে। বিগত সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই যে কোনো জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের মানুষ যাতে সহজেই ভারতে যেতে পারে তার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এ জন্যই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রেখেছে। দেশে একের পর এক ফাইভ স্টার হোটেল ও রিসোর্ট গড়ার সুযোগ দেওয়া হলেও সর্বাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো সরকারি-বেসরকারি একটি হাসপাতাল গড়ে তোলারও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ব্যবসায়ী সুজাউর রহমান শুভ্র জানান, তিনি ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা মহানগর টাটা মেডিকেল সেন্টার (টিএমসি) থেকে অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন করেন। এর পর থেকে প্রতি বছর তিনি সেখানকার চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত চেকআপ করিয়ে আসছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে ভিসা জটিলতার কারণে তিনি ভারতে যেতে পারছেন না। অথচ দেশে তার এই চেকআপ করার মতও যথেষ্ট সুযোগ নেই।

ক্ষোভ প্রকাশ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা গত ১৫ বছর অবৈধ টাকা পাহাড় গড়ে সামান্য সর্দি-জ¦রে সিঙ্গাপুর-মালেয়শিয়ায় গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। তাই তারা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে নজর দেননি। বরং ভারতকে সুযোগ দিতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রাখার ষড়যন্ত্রে মেতে থেকেছেন। এতোদিন দেশের নিন্ম-মধ্যবিত্ত মানুষ যে কোনো জটিল রোগে ভারতে গিয়ে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ায় সে ষড়যন্ত্র কেউ টের পায়নি। তবে এখন তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এদিকে বাংলাদেশের রোগীদের উপর ভারতের হাসপাতালগুলো কতটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল, সে চিত্রও এখন প্রকাশ পেয়েছে। জানা গেছে, ভিসা বিধিনিষেধ এবং দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে গত নয় মাসে বাংলাদেশি রোগীদের সংখ্যা তীব্র হ্রাস পেয়েছে। ফলে ভারতের চিকিৎসা পর্যটন খাত উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের হাসপাতালগুলির রাজস্বের উপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

অ্যাপোলো, মণিপাল এবং ম্যাক্স হেলথকেয়ারের মতো হাসপাতালগুলি বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ১৫-৫০ শতাংশ হ্রাসের কথা জানিয়েছে। এই গোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল হাসপাতালগুলির জন্য, আন্তর্জাতিক রোগীর রাজস্ব ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এছাড়া বাংলাদেশি চিকিৎসা পর্যটকদের সেবা প্রদান, হোটেলে আবাসন, পরিবহন ব্যবহার এবং স্থানীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কোলকাতার মতো শহরগুলির ব্যবসায় নাটকীয় মন্দা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ ভারতের চিকিৎসা পর্যটনে একটি প্রধান অবদানকারী, ভারত কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত চিকিৎসা ভিসার প্রায় ৪৫-৬০ শতাংশ। তবে, ২০২৪ সালে, এই ভিসায় ২৮.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যা মূলত বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর ভারতের ভিসা সীমিত করার সিদ্ধান্তের কারণে। 

জানা গেছে, অ্যাপোলো হাসপাতালগুলি বছরের প্রথমার্ধে আন্তর্জাতিক রোগীদের সামগ্রিক রাজস্বে ১৫ শতাংশ হ্রাসের রিপোর্ট করেছে, যার প্রধান কারণ বাংলাদেশী রোগীদের কাছ থেকে রাজস্ব ২৭ শতাংশ হ্রাস। মণিপাল হাসপাতালগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মাসগুলিতে বাংলাদেশী রোগীদের আগমনে ৫০-৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা তাদের আন্তর্জাতিক রোগীর রাজস্বে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলেছে। ম্যাক্স হেলথকেয়ার বাংলাদেশের বাজার থেকে রাজস্বে ৫০ শতাংশ হ্রাস লক্ষ্য করেছে, যা তাদের মোট আন্তর্জাতিক রাজস্বে প্রায় ৫ শতাংশ অবদান রাখে। সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশী চিকিৎসা পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল কিছু হাসপাতাল ৫ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব হ্রাসের রিপোর্ট করেছে, যার ফলে রোগীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা পর্যটকদের সংখ্যা হ্রাসের ফলে কলকাতার মতো ভারতীয় শহরগুলিতে আতিথেয়তা, খুচরা বিক্রয় এবং পরিবহনের মতো আনুষঙ্গিক খাতগুলিতেও প্রভাব পড়েছে, যেখানে পূর্বে বাংলাদেশী দর্শনার্থীদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা দেখা যেত। ‘মিনি-বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত অঞ্চলগুলিতে স্থানীয় ব্যবসাগুলি জানিয়েছে যে, রোগীর সংখ্যা ২৫ শতাংশের নিচে এবং দৈনিক গ্রাহকদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।