গ্যাস-বিদ্যুতের তীব্র সংকট

শিল্প উৎপাদনে ভয়াবহ ধস

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৫, ১৬:০৫ | আপডেট: ২৬ মে ২০২৫, ১৮:২৯

সাখাওয়াত হোসেন
ফাইল ফটো

দেশের শিল্প-কারখানাগুলো বেশ কিছুদিন ধরে গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকটে ভুগছে, যা উৎপাদন ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ সংকটে সিরামিক ও স্টিল শিল্পের উৎপাদন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদন ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। 

সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪১০ কোটি ঘনফুট, কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৫৫ কোটি ঘনফুট, যা মোট চাহিদার প্রায় ৬২ শতাংশ। এরমধ্যে শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার এমএমসিএফডি হলেও সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ এমএমসিএফডি, যা চাহিদার মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। সরবরাহকৃত মোট গ্যাসের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ শিল্প খাতে বরাদ্দ করা হচ্ছে, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। 

এদিকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৫৪ মেগাওয়াট হলেও ২৩ মে ডে পিকআওয়ারে ১৩ হাজার ৩৩৬ মেগাওয়াট এবং ইভিনিং পিকআওয়ারে ১৫ হাজার ২১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। যা গড়ে মোট সক্ষমতার ৫২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটে উৎপাদন হ্রাস, রপ্তানি আদেশ বাতিল এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নয়ন এবং বিকল্প জ্বালানি উৎসের ব্যবহারে জোর দেওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, শিল্প খাতে বরাদ্দকৃত গ্যাস বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে সরিয়ে নেওয়ায় দেশের কল-কারখানাগুলো চরম গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদনে বড় ধরণের ধস নেমেছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে শিল্পমালিকদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় ৪০০ গ্যাসনির্ভর কারখানা পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। বিশেষ করে গাজীপুর, কোনাবাড়ি, শফিপুর, নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই ও মানিকগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ প্রায় শূন্যেও কোঠায় নেমে এসেছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস ও ব্যাংকিং সংকটে উৎপাদনমুখী শিল্প চরম বিপর্যয়ে পড়েছে। গ্যাসের চাপ এতটাই কম যে শিল্পাঞ্চলগুলোতে মেশিনারিজ চালু রাখা দুস্কর হয়ে পড়েছে। ফলে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা থাকলেও গ্যাস সংকটই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও আশুলিয়ায় গ্যাসের চাপ কোথাও কোথাও প্রায় শূন্যেও কোঠায়।

এ অবস্থায় উৎপাদন চালানো সম্ভব নয়। ব্যাংকিং খাত নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যাংকগুলো ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে বিলম্ব করছে, ওভার ডিও হলেই এলসি বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে পণ্য সময়মতো পাঠানো যাচ্ছে না, অনেক সময় এয়ার শিপমেন্ট বা ডিসকাউন্ট দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এতে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছে রপ্তানিকারকরা।

এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, গাজীপুর অঞ্চলে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ নেমে এসেছে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে শিল্পকারখানাগুলো ব্যয়বহুল বিকল্প জ্বালানি ডিজেল, এলপিজি ও সিএনজি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

বিটিএমএ’র তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১ হাজার ৮৫৪টি টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে, যেখানে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০০টি কারখানা গ্যাসনির্ভর, বিশেষ করে স্পিনিং মিলগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলধনের পরিমাণ ১০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানি আদেশ বাতিল এবং বিদেশি ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।

শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, গ্যাসের দাম দুই দফায় বাড়ানো হলেও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। উদ্যোক্তারা বলছেন, এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হচ্ছে। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল যায়যায়দিনকে জানান, কারখানাগুলোর অনেক সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে, অথচ জ্বালানি ও জনবল খরচ ঠিকই বহন করতে হয়েছে, যা মালিকদের মূলধন থেকেই গেছে। ফলে অনেকেই খেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। 

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৬৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন ১ হাজার ৮৪২মিলিয়ন এবং আমদানিকৃত এলএনজি ৮৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা ও সরবরাহের এ বিশাল ব্যবধানের কারণে শুধু শিল্প নয়, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক খাতও সংকটে পড়েছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে শিল্প খাতের গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে তিতাস গ্যাসের অপারেশন বিভাগ। 

এদিকে চট্টগ্রামে দৈনিক ৩০-৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি চলছে। সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সিরামিক শিল্পে উৎপাদন কমে গেছে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ সংকট অব্যাহত থাকলে দেশের শিল্প খাতে ভয়াবহ মন্দা দেখা দেবে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট কেন কাটছে না জ¦ালানী বিশেষজ্ঞরা তা স্পষ্টভাবে বারবার উপস্থাপন করলেও নানা জটিলতায় এ সংকট নিরসনের উদ্যোগ ফাইলবন্দি হয়েই থাকছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো, বিশেষ করে বিয়ামান গ্যাসফিল্ডগুলোতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অথচ নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে গত এক যুগে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন দিনে দিনে কমছে।  এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২০২২ সালের পর থেকে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এই দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে এলএনজি আমদানি করতে পারছে না বা দেরি করছে। ফলশ্রæতিতে এলএনজি আমদানিতে বিলম্ব বা সীমাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।

এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাব দিন দিন বাড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ এখনও গ্যাসভিত্তিক। গ্যাস সরবরাহ কম হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রয়োজনীয় উৎপাদন করতে পারে না। কয়লা ও ডিজেলের জোগানেও ঘাটতি বা ব্যয় বেশি হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি ও পুরনো অবকাঠামোর আধুনিকায়ন না হওয়ায় অনেক বিদ্যুৎ  কেন্দ্র অকার্যকর হয়ে আছে। জ্বালানি আমদানিতে সিদ্ধান্ত নিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক  দোলাচল আছে।

এছাড়া শিল্প ও আবাসিক খাতে অনেক জায়গায় অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা কম থাকায় অপচয় বেশি হচ্ছে। মিটারিং ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সঠিক চাহিদা বা ব্যবহার হিসাব করা কঠিন হয়ে পড়েছে।