মারুফকে বিক্রির পরিকল্পনা হয়েছিল

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০৭

যাযাদি ডেস্ক
মাহিরা বিনতে মারুফাকে উদ্ধার করে র্যাব

সকাল সাড়ে ৭টায় মিরপুর কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন মাহিরা বিনতে মারুফ।

কুড়িলের বসুন্ধরা গেট এলাকা থেকে একটি ভাড়ায় চালিত বাইক নিয়ে রওনা হন। বাইক নিয়ে মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বরের কাছাকাছি পৌঁছলে প্রচণ্ড জ্যামে পড়েন। 

জ্যাম না ছাড়ায় বাইক থেকে নেমে কিছু রাস্তা হেঁটে গিয়ে গোল চত্বর থেকে ভিক্টর প্লাস নামে একটি বাসে ওঠেন। 

বাসের জানালাসংলগ্ন সিটে বসার কিছুক্ষণ পরে এক মাঝবয়সী নারী এসে পাশের সিটে বসেন। 

একপর্যায়ে ওই নারীকে বাসের বাইরে থেকে কেউ একজন কিছু একটা দেওয়ার জন্য জানালা খোলেন এবং ওই নারী সেটা হাত বাড়িয়ে নেন। 

যে বস্তুটি এই দুজনের মধ্যে আদান-প্রদান হয়, সেটা ধরা হয় মাহিরার নাকের সামনে। 

এর পরে ধীরে ধীরে চেতনা হারাতে থাকেন মাহিরা। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন নিজেকে আবিষ্কার করেন টিনে ঘেরা নির্মাণাধীন ভবনের একটি কক্ষে। মাহিরা এমনটাই জানিয়েছেন গণমাধ্যমকে।

গত রোববার মাহিরা রাজধানী থেকে নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। 

অপহরণকারীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসার ঘটনা বর্ণনা করেছেন মাহিরা। 

তিনি বলেন, ‘আমার যখন জ্ঞান ফেরে, তখন নিজেকে টিনে ঘেরা একটি নির্মাণাধীন ভবনের রুমে মাদুরের ওপর দেখতে পাই। 

আমার আশপাশে একজন নারী ও চার থেকে পাঁচজন পুরুষ মানুষ ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় আলাপ করছিলেন। 

এদের মধ্যে এক নারীকে আমি চিনতে পেরেছি, যিনি বাসে আমার পাশের সিটে বসেছিলেন।

আর একজন পুরুষকে চিনেছি, যাকে ওই বাসেই আমার সিটের সামনের দিকে দেখেছিলাম। বাকি যে পুরুষ মানুষগুলো ছিল, তাদের দেখতে বিদেশি মনে হয়েছিল। 

এক পর্যায়ে, ওখানে যারা ছিল আমি তাদের বলি—আমি এখানে কেন? আমার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। তখন বিদেশিমতো দেখতে একজন বলেন, নো ওয়ে!’ 

অপহরণকারীরা মাঝে মাঝে বাংলাতেও কথা বলছিল উল্লেখ করে মাহিরা বলেন, ‘তারা যেসব কথাবার্তা বলছিল, সেগুলো এমন ছিল যে, আমাকে কীভাবে এখান (আটকে রাখার স্থান) থেকে বের করবে। 

এজন্য কে কত টাকা পাবে। এ ছাড়া আমার ছবিসহ নিউজ হয়েছিল। এজন্য তারা উদ্বিগ্ন ছিল। আমাকে কলেজ ড্রেসসহ এখান থেকে বের করলে সবাই চিনে যাবে। 

তাই আমার পোশাক পরিবর্তন করতে হবে এবং আমার চুলগুলো কাটতে হবে। যেন কেউ না চেনে। এজন্য তারা আমাকে একটা ট্রাউজার ও টিশার্ট দেয় চেঞ্জ করার জন্য।

যেহেতু একজন নারী বাদে ওখানে সবাই পুরুষ মানুষ ছিল। তাই চেঞ্জ করার জন্য আমাকে একটু স্পেস দেওয়া হয়। সেই সময় পাশের কক্ষে সবাই কী একটা বিষয় নিয়ে যেন বাকবিতণ্ডায় জড়ায়। তখন ওখানে সবাই চলে যায় আমাকে একা রেখে। এই সুযোগে আমি নিচে নেমে আসি এবং পালাতে পারি।’ 

মাহিরাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেটি আনুমানিক সাত-আটতলা নির্মাণাধীন ভবন। এই ভবনের আশপাশে আরও দু-তিনটি একই রকম ভবন আছে। 

সেগুলোর পাশে বালু, ইট, সিমেন্টের মতো নির্মাণসামগ্রী দেখেছিলেন মাহিরা। 

আটকে রাখার স্থান থেকে বেরিয়ে আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ মিনিট হেঁটে ও দৌড়ে তিনি ঢাকা-মানিকগঞ্জ মহাসড়কে কাছে পৌঁছান। 

এরপর একজন বাইকারের সহায়তা নিয়ে আসেন সাভার নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের কাছাকাছি। 

এমন বর্ণনা দিয়ে মাহিরা বলেন‌, ‘পথে আমি অনেক রিকশাচালক ও বাইকারের কাছে হেল্প চাই; কিন্তু কেউ আমার পোশাক ও খালি পা দেখে হেল্প করেনি। একজন বাইকারের সাহায্যে আমি এক জায়গায় এসে নামি। 

তিনি আমাকে বলেন, ‘এটা নিউমার্কেট।’ আমি ভেবেছিলাম ঢাকা নিউমার্কেট। এরপর পাশের একটি টং দোকানে গিয়ে একজন লোকের কাছে অনুরোধ করি, তার ফোন থেকে আমার বাবাকে একটি কল করার জন্য। 

আমার বাবাকে কল করার পরে তারা লোকাল থানার পুলিশ, সাভারের এসপি ও র‍্যাবের কাছে বিষয়টি জানান। এরপর পুলিশ ও র‍্যাব আসে আমার নিরাপত্তার জন্য।’ এরপরে সবকিছুই তো সবার জানা।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহিরা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বেশ ট্রমায় আছেন। 

মাহিরা তার বড় বোন মারিয়া বিনতে মারুফ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। তবে একটি পরীক্ষা দিতে না পারলেও পরের সব পরীক্ষা দিচ্ছেন। 

পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মানসিক সাপোর্ট জোগাচ্ছেন তার পরিবারের সদস্যরা। বড় বোন মারিয়া বলেন, ‘মাহিরাসহ আমাদের পরিবারের সবাই বেশ ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। 

ও মানসিকভাবে এখনো স্থিতিশীল নয়। আমরা ওর বাকি পরীক্ষার ব্যাপারে ভাবছি।’ এই বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাহিরা একটু স্থিতিশীল হলে ওর স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।’ 

এ ঘটনার পর রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি জিডি করেন মাহিরার মা। তাকে উদ্ধারের ব্যাপারে এই থানা-পুলিশ তৎপর ভূমিকা পালন করেছিল। 

এ প্রসঙ্গে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুল হাসান বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থী উদ্ধার হয়েছে এবং পরিবারের কাছে তাকে সেদিনই হস্তান্তর করা হয়েছে। 

এই বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি। পরিবার অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব। তবে এটি অপহরণ না প্রেমঘটিত ঘটনা, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। তদন্ত হলেই বিস্তারিত জানা যাবে।’