মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাথা উঁচু করে বাঁচুক সবাই

কাকলী তালুকদার
  ২৭ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৩৭

মুনাফার লোভে প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছে মুনাফার ওপরে কোনো কথা নেই। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষা থেকে জেনেছি, আত্মহত্যা মহাপাপ। জ্ঞানীরা যখন মুখ ভারী করে এ বাক্যটি আমাদের বলেন তখন শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? কী কারণে এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করে তোলে?

আমাদের তো সবারই নিজের জীবনটি খুব প্রিয়। কী এমন বিষয়গুলোর জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়? অনেক কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে কিন্তু বিষয়টি ঘুরেফিরে আবেগের। স্বার্থপর এবং বাস্তবতায় আস্থার মানুষ কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। সে নিজেকে মোকাবেলা করে বেঁচে থাকে সমাজে। যারা আত্মহত্যা করে তারা ভীতু, অনেকেই তাই বলেন, এটা হেরে যাওয়া, সত্যিই তাই এটা হেরে যাওয়া! কিন্তু যারা আত্মহত্যা করে তারা ভীতু নয়, একজন ভীতু মানুষ নিজেকে হত্যা করতে পারে না কখনই। হাজারো যন্ত্রণা নিয়ে আমরা প্রতিদিন বেঁচে থাকি।
জীবন বা বেঁচে থাকাটা একটা চলমান সংগ্রাম, আমি তাই অনুভব করি। তাই সুখ-দুঃখ, রাগ-অভিমান, যন্ত্রণা-বিষাদ, ভালোবাসা-হতাশা বিষয়গুলো আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু আমরা ঠিক কতজন ‘সুখ’, ‘আনন্দ’, ‘ভালোবাসা’ ছাড়া অন্য অনুভূতিগুলোর মূল্যায়ন করি? সবাই সুখের পেছনে ছুটি কিন্তু দুঃখ বিষয়টির অমর্যাদা করি। সুখ কি কোনো বস্তু? নাকি একটি অনুভূতির নাম? মিষ্টি, তিতা, টক, ঝাল, একেকটি স্বাদের নাম। প্রতিটি স্বাদের ভিন্নতা রয়েছে। অনুভূতিগুলোরও নিজস্ব ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের সমাজে কি কোথাও এসব অনুভূতির গুরুত্ব শেখানো হয়? কিছু কিছু পরিবারে কিছুটা শেখানোর চেষ্টা হয় সত্য, তবে তা আমাদের মানসিক গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা কি রাখছে? সব পরিবারে কি এই অনুভূতির মূল্যায়ন নিয়ে সিরিয়াসলি কেউ ভাবছেন? সাবিরা মেয়েটির আত্মহত্যার খবর আমি ফেসবুকে দেখেছি। না, আমি এখনো তার মৃত্যুযন্ত্রণার ভিডিও দেখিনি, দেখার আগ্রহবোধও করছি না। শুধু ভাবছি, মেয়েটিকে যদি একটু নির্ভরতা দিতে পারতাম, তবে হয়তো একটি আত্মহত্যার সংখ্যা কম হতো। কয়েক দিন আগে সাতক্ষীরার একজন স্কুল অথবা কলেজ পড়–য়া ছেলে আত্মহত্যা করেছে। একই কারণ, সম্পর্কবিষয়ক। আমি কোনো মৃত্যুই সহ্য করতে পারি না, তার মধ্যে আত্মহত্যা সে তো আরো না। সাবিরা বা অর্ণব তারা কি নির্ভরতা খুঁজেছিল সম্পর্কে? তাই আবেগগুলো সামলাতে পারছিল না?
সন্তানদের আবেগের জায়গাগুলো আমরা কয়জন মূল্যায়ন করি? পেটের চাহিদার সঙ্গে শরীর ও মনের চাহিদাগুলোও একটা বয়সে তৈরি হয় খুব স্বাভাবিক নিয়মে। যার ফলাফল আমরা প্রতিটি মানুষ এবং আমাদের আবেগ-অনুভূতিগুলোর বহিঃপ্রকাশ। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সর্ম্পক তৈরি না হলে কি মানুষের সৃষ্টি হতো? বংশ বৃদ্ধি বা বেঁচে থাকার আকর্ষণই প্রকৃতির ধর্ম। নিজেকে বড় প্রমাণ করার চেষ্টা বা শক্তিচর্চার বিষয়টিও জীবের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিচার-বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এখানেই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীবের পার্থক্য। তবে বিচার-বিবেচনার মানদ- ও অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়! কারণ মানুষের তৈরি মানদ-কেই অনেক সময় সর্বোচ্চ সীমানা হিসেবে ভাবতে থাকি আমরা। আজ সাবিরারা যখন মরে যায় তার মৃত্যুটিকে জায়েজ করতে অনেক মানুষ উঠেপড়ে লাগে। যেন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই শ্রেয়! এই যে আমাদের চিন্তার দৈন্য, এর মূল কোথায়? দিনের পর দিন গলা কেটে হত্যার বৈধতা দিতে গিয়ে সরকার যেভাবে ধর্মের দোহাই দিচ্ছে, সেই দৈন্যতা কি একেই সুতায় গাঁথা? মার্ক টোয়েনের একটি ছোট গল্পের বিষয় আমার মনে গেঁথে আছে আজো। এক মধ্যবয়সী নারীকে ডাক্তার বলে দিয়েছেন তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না।
সেই নারী জানালায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখেন প্রতিদিন। পাশের বাড়ির জানালায় একটি সবুজ পাতা বাহারের গাছ দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে গেছে। তিনি যখন থেকে আগাম মৃত্যুর খবর জেনেছেন সেই সবুজ পাতার গাছটির পাতাগুলোও একটি একটি করে ঝরে যাচ্ছিল। একাকিত্বে থাকা সেই নারী ঝরে যাওয়া পাতাগুলো প্রতিদিন গুনতে লাগলেন আর ভাবতে লাগলেন এই গাছটিতে যেদিন শেষ পাতাটি ঝরে যাবে, সেদিন তারও মৃত্যু হবে। গাছটি যে বাসার দেয়ালে সেখানে এক চিত্রশিল্পী বাস করেন। সেই মধ্যবয়সী নারীর গাছ নিয়ে ভাবনার বিষয়টি চিত্রশিল্পী আরেকজনের মাধ্যমে জেনে যান। এরপর জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নারী এবং তার নিজের দেয়ালে সবুজ পাতার গাছটি তারও পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। একদিন খুব বৃষ্টির দিনে সেই নারীর জানালা বন্ধ দেখে সেই চিত্রশিল্পী গাছের ছবিটি দেয়ালে কয়েকটি পাতাসহ এঁকে দিলেন। দূর থেকে মনে হয় গাছটি আরো সুন্দর হয়ে বেঁচে আছে। মূল গাছটির পাতা সব ঝরে গিয়েছিল সেদিন। টানা দুই দিন বৃষ্টির পর সেই নারী যখন জানালা খুললেন অবাক হয়ে দেখলেন গাছের পাতা আরো সবুজ হয়েছে। সেই নারী নিজের জীবন নিয়ে খুব ইতিবাচক ভাবনা ভাবতে থাকলেন। কিন্তু কদিন পরই পাশের বাড়ির সেই চিত্রশিল্পীর মৃত্যু সংবাদ শুনতে পান সেই নারী। বৃষ্টিতে ভিজে ছবি আঁকতে গিয়েই অসুখে পড়ে শিল্পীর মৃত্যু হয়। ছবি আঁকার গল্পটি সেই নারীর অজানাই থেকে যায়। মানুষের দায়িত্ববোধ একদিকে যেমন সমাজকে সুন্দর করে, ঠিক দায়িত্বহীনতা সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। সাবিরা বা অর্ণবের আত্মহত্যার দায় আমাদের সবার। আজ তাদের ব্যর্থতার গল্পগুলো বলে নিজেদের দায়িত্বহীনতাকে আড়াল করার যে অপচেষ্টা তা আমাদের দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ। মাঝে মাঝে সিগারেট কোম্পানির মতো ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ আর ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ বলে নিজের দায় এড়াচ্ছেন! তবে তো সিগারেট কোম্পানির মতো মুনাফালোভীর চরিত্রটির সঙ্গে আমাদের সমাজপতিদের কোনো তফাত নেই। বিপদে মানুষকে উপহাস না করে পাশে দাঁড়ানোর চর্চাটা আমাদের করতে হবে। নয়তো উপহাসকে মৃত্যুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে কারো কারো। তার বিনিময়ে নিজের জীবনকে নিমেষেই শেষ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। আর সেই সংখ্যাটা নারীদের ক্ষেত্রে বেশি। কেন? নারীরা কি তবে সেই নীতিনির্ধারণের বলয়ে আক্রান্ত? সেই পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অশুভ চক্রের আজ শুধু নারী নয় পুরুষও শিকার। তাই নিজেকে সভ্য দাবি করার আগে ভেবে দেখেছেন কি আমাদের ভুলগুলো বা বৈষম্যগুলো ঠিক কোথায়?
আত্মহত্যা মহাপাপ বলার আগে চলুন আত্মহত্যার কারণগুলো খুঁজি। আত্মহত্যার উপাদানগুলো সমাজ থেকে নির্মূল করি এবং এমন সমাজ আমরা নির্মাণ করি যাতে কেউ হতাশাগ্রস্ত না হয়। প্রতিটি মানুষ বাঁচুক মর্যাদা নিয়ে, মাথা উঁচু করে।
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে