বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংবিধান : নতুন সামাজিক চুক্তির অপরিহার্যতা

আবদুল আউয়াল মিন্টু
  ৩০ জুন ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ৩০ জুন ২০২১, ১৩:১২

সংবিধান ও আইনের শাসন যদি আমাদের সমাজের বর্তমান বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, মারামারি, খুন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাত্রাহীন বাড়াবাড়ি, জোরপূবক অন্তর্ধান (ভড়ৎপবফ ফরংধঢ়ঢ়বধৎধহপব), আদালত প্রাঙ্গণে মিথ্যা মামলার আসামিদের ভিড় ও কান্নার শব্দ, নির্বিচার ও বিনা-বিচারে হত্যা, গ্যাং সংস্কৃতির আবির্ভাব ও প্রভাব, ন্যায়-বিচারের অন্তর্ধান, জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা ও দলীয়করণ এবং সামাজিক ব্যর্থতাগুলোকে বিবেচনায় এনে সমাজের বর্তমান পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করা হয় এবং যেসব অভিশাপ জনজীবনে শেকড় গেড়ে বসেছে সে তালিকার দিকে তাকান, তাহলে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে, দেশের বর্তমান সংবিধান নাগরিকদের কোনো অধিকার ও তাদের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করছে না। অথচ সংবিধানের মূলমন্ত্র হলো- 'প্রশাসনভিত্তিক সরকার কাঠামোতে শাসিতদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের যেমন ক্ষমতা থাকবে, তেমনি সংবিধানের আওতায় গঠিত সরকারের ক্ষমতাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।' সংবিধানে যাই থাকুক, যে ভাষাই ব্যবহৃত হোক, যে মূলনীতিই বর্ণনা ও অনুসরণ করা হোক না কেন, উপরিউক্ত মূলমন্ত্র হলো সংবিধানের নির্যাস। সংবিধানের নির্যাস অনুযায়ী জনগণের কিছু মৌলিক অধিকার অবশ্যই থাকবে যেমন- জীবনরক্ষা, বাক-স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করা ও কথা বলার অধিকার, নিজ-গতিবিধি, একান্ত গোপনীয়তা, চলাফেরার অধিকার ও মানবিক মর্যাদা। তাছাড়া ব্যক্তির নিজগৃহে স্বাধীনতা, নিজগৃহ দখলে রাখার অধিকার, টেলিযোগাযোগ, ব্যক্তিগত কথাবার্তা, পারিবারিক জীবনে গোপনীয়তার অধিকার ইত্যাদি। টেলিভিশন দেখলে বা খবরের কাগজ পড়লে সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান ব্যক্তি মানুষের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, সমাবেশ, নিজগৃহ দখলে রাখা বা একান্ততার কোনো নিশ্চয়তা দিতে অক্ষম। অতএব, কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই বলা যায় যে বাংলাদেশের বিদ্যমান 'সংবিধান অকার্যকর', এমনকি দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে এটা একটা নিরর্থক কাগজের পান্ডুলিপি মাত্র। বর্তমান সংবিধানের আওতায় একদিকে সাধারণ নাগরিকরা যেমন তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারছেন না, অন্যদিকে সরকারকে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ বা বিতর্কিত প্রয়োগ থেকে সংযত করতে পারছেন না বা নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। অথচ এগুলোকে ভিত্তি করেই দেশে দেশে সংবিধান প্রণীত হয় বা রচিত হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যে কোনো দেশের সংবিধান সাধারণত সে দেশের কোনো এক বিশেষ সময়ের সাধারণ জনগণের চিন্তাভাবনা, মনোভাব ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করার একটি মৌলিক দলিল। সংবিধান নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি। সংবিধান একদিকে যেমন কিছু স্বচ্ছ বিধিনিষেধ দ্বারা জনগণের সার্বভৌমত্ব সীমিত রাখে, অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহারে সরকারের ক্ষমতাকে নানা বিধিবিধান, সুনির্দিষ্ট নীতিপ্রথা, প্রমিত এবং স্থায়ী আইন দ্বারা নির্ধারিত সীমার চৌহদ্দিতে সীমিত করে নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য করে। সংবিধান অন্যান্য আইন ও আইনসংক্রান্ত দলিল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেননা, সংবিধান এমন সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে যেগুলো অন্যান্য বিষয় থেকে অনেক বেশি মৌলিক ও স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। তখন সরকার ছিল একদলীয়, একপেশে, দেশ ও সমাজ ছিল বিভক্ত, মেরুকৃত, দুর্বল এবং বিধ্বস্ত। ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত সমাজের পটভূমিতে জনগোষ্ঠীর একটা অংশ কর্তৃক রচিত সংবিধান সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। সংবিধানের নৈতিক কর্তৃত্বের চূড়ান্ত রহস্য নির্ণয় করা যায় শুধু তখনই, যখন সংবিধান প্রণয়নের সমসাময়িককালে জাতি ও সমাজের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সেই সঙ্গে সংবিধান প্রণেতাদের নৈতিকতা, গুণাগুণ, জ্ঞান, মনোভাব, সদিচ্ছা ও সামর্থ্য থেকে, যারা জনসাধারণকে সংবিধানে বর্ণিত ও উলিস্নখিত নীতিগুলো অনুসরণে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। অন্যদিকে নেতার অনুসরণে বাধ্য ও অনুপ্রাণিতদের দ্বারা রচিত সংবিধান সাধারণ জনগণকে সমাজ গঠনে অনুপ্রাণিত করতে পারে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সংবিধান রচনার পর পরই বাংলাদেশের ঘটনাপুঞ্জ ও ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। সংবিধান প্রণয়নের পর আমাদের সমাজে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবর্তন সামাল দিতে গিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে সংবিধানে যেসব সংশোধন সংযোজিত হয়েছে, সেগুলোর পক্ষপাতপ্রবণতার কারণে সাধারণ মানুষের মনে খোদ সংবিধান তার আত্মিক, তাত্ত্বিক মাহাত্ম্য ও নৈতিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। এ ছাড়া গত ৫০ বছরের কালপরিক্রমায় নানা সংশোধনী আনার ফলে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর চরম অবক্ষয় ঘটেছে। যারা পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে সংশোধন করেছেন তাদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য আরও সংশোধনী যোগ করে সংবিধানকে জনগণের উপর অত্যাচার-নির্যাতন ও নির্বিচারের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক, মিশ্র বা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বিশ্বায়ন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জনসমাজও কতগুলো মৌলিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অতিক্রম করছে। আমাদের সংবিধানে সংযোজিত সংশোধনীগুলোর সঙ্গে এসব পরিবর্তনের কোনো আভাস পরিলক্ষিত হয় না। বরঞ্চ বলা যায় এসব সংশোধনী পরিবর্তিত সমাজকে পূর্ববর্তী সমাজে ফেরত নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। এসব প্রক্রিয়ায় সম্মিলিত প্রভাবে বাংলাদেশের সংবিধান বর্তমানে সমাজের উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ না করে বরং সমাজের অবনতির জন্য ক্ষমতাসীনরা এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এ দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মতো অনেকের ধারণা হলো; হেলা-ফেলা, এমনকি নিয়মমাফিক পর্যালোচনার মাধ্যমে সংশোধনী করে বর্তমান সংবিধানকে বাংলাদেশের জনসমষ্টির মতো উদ্বায়ী (ঠড়ষধঃরষব), প্রাণবন্ত, প্রগতিশীল ও দ্রম্নত পরিবর্তনশীল জনসমাজে কোনো স্থিতিদায়ক প্রভাব কায়েম করতে পারবে না। অতএব, সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রয়োজন হলো 'এক নতুন সামাজিক চুক্তি'। দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) বলেছেন, 'কোনো সমাজকে পুনর্নির্মাণ করার প্রয়োজন দেখা দিলে সে সমাজকে তার পুরনো পরিকল্পনার বুনিয়াদে গড়ার চেষ্টা করে কোনোই লাভ নেই।' এই মন্তব্য ধর্তব্যে না আনলেও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই বলা যায়, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে নতুন এক সামাজিক চুক্তি রচনা করা আবশ্যক। অর্থাৎ নতুন সংবিধান প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সংবিধান হবে শিল্প ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সমাজের জন্য যুগোপযোগী। সংবিধানে নতুন সামাজিক চুক্তির অপরিহার্যতা মৌলিক অধিকারগুলোর নিরঙ্কুশ নিশ্চয়তা না থাকায় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ায় আমাদের সমাজে ব্যর্থতা, অনিশ্চয়তা, অশুভ আঁতাত, রাজনৈতিক অনৈতিকতা ও গলদ জনগণকে দিন দিন গ্রাস করে চলেছে। সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ বিভক্তির মাধ্যমে দুর্বল করে দিয়ে একটা গোষ্ঠী নিজেদের পারিবারিক ধারাবাহিকতায় এক ধরনের পিতৃত্বসুলভ এবং ব্যক্তিগত আনুগত্যভিত্তিক (জি-হুজুর) শাসন-পদ্ধতি কায়েম করে ফেলেছেন। ক্রমবর্ধিত হারে এই গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে একটি কেন্দ্রায়িত অভিজাততন্ত্রমুখী সমাজ গড়ে তুলছেন। এ কারণে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে বিভিন্ন দল-উপদল সৃষ্টি হচ্ছে এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ, সংশয় ও সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সমাজে সহিষ্ণুতা, সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছা, আপসরফার মানসিকতা ও অন্যের অভিমতের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব লোপ পেয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে জনগণের জীবন হুমকির সম্মুখীন। এর কারণ, দেশের বর্তমান সংবিধান নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। অন্যদিকে এ সংবিধান নাগরিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য স্বাধীনভাবে পালন করতেও দিচ্ছে না। তাছাড়া দেশের জনসাধারণের (আমিসহ) একটা বৃহত্তর অংশের কাছে, সম্ভবত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সংবিধানে যোজিত মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতিমালা কী তা বোধগম্য নয়। তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ পথহারা পথিকের মতো দিনযাপন করছে। অন্য যে কোনো দেশের সংবিধানের মতো বাংলাদেশের সংবিধানেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিধিবিধান আছে বলে বিজ্ঞ কিন্তু দলীয় আইন বিশেষজ্ঞরা আমাদের নিত্য-নিয়ত, প্রতিনিয়ত বোঝান। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকারগুলো সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেন। কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া আছে বলে কথায় কথায় তারা উলেস্নখ করেন। সরকার পরিচালনায় 'প্রতিবিধায়ক ভারসাম্য ব্যবস্থা' (পযবপশং ধহফ নধষধহপবং) ও 'ক্ষমতার পৃথকায়ন' (ঝবঢ়ধৎধঃরড়হ ড়ভ চড়বিৎ)-এর মতো কাঠামোগত সীমা আরোপক বিধিনিষেধগুলো যা সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোও আছে বলে ক্ষমতাসীনরা বারবার জোর দিয়ে বলেন। এছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু ও সাবলীল কার্যকলাপ জনগণের কল্যাণে পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য যেসব বিধিবিধানের প্রয়োজন সেগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থাপিত থাকা সত্ত্বেও এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের অকল্যাণে, কিন্তু দলীয় কল্যাণে অপ্রতিরোধ্যগতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে চলেছেন। একই সঙ্গে নিত্য-নিয়ত রাজনৈতিক বক্তৃতার প্রতিটি বুলিতেই বলা হয় যে 'আমাদের সংবিধান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলোর একটি' এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি নিরাপত্তা, ন্যায়-বিচার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোর বিকাশ ও শক্তিশালী করার জন্য যেসব প্রাতিষ্ঠানিক উপায় ও ব্যবস্থা প্রয়োজন সেগুলো যথারীতি সংবিধানে স্বর্ণাক্ষরের মতো সন্নিবেশিত করা আছে বলে উচ্চৈঃস্বরে গলাবাজি করেন। কোনো সময় সমস্যার কথা বলেন না। সমস্যা হলো সংবিধানের অনেক অনুচ্ছেদ, একটির সঙ্গে আরেকটি বৈপরীত্যময়। এমনকি সাংঘর্ষিক। এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতও রয়েছে। সংবিধানের একটি বাক্যে যেসব অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, অন্য এক বাক্যে সেগুলো সীমিত বা অস্বীকার করা হয়েছে। অনেক অনুচ্ছেদ পরস্পরবিরোধী। ফলে ক্ষমতাসীনরা যাই করুক, ভালো-মন্দ, খুন-ঘুম, বৈধ-অবৈধ সবই সাংবিধানিক বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে আবার ১৯৭৩ সালে ভালো-মন্দ যা আছে যদি তাতে কুলিয়ে উঠতে পারা না যায় তাহলে ১৭০০ বা ১৮০০ শতাব্দীর ঘুণেধরা আইনগুলোকে ধুয়ে-মুছে সেগুলোকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সরকার পিছু হটে না। এ অবস্থায় আমার প্রশ্ন হলো, সংবিধান থাকা সত্ত্বেও যদি সরকার খেয়াল-খুশিমতো যখন ইচ্ছা তখন জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে পারে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজ ও রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে, তাহলে সংবিধান থাকা বা না থাকার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সংবিধান থাকা সত্ত্বেও যদি দেশের শাসনব্যবস্থা এত অবনতির শেষ সীমায় পৌঁছতে পারে তাহলে সংবিধান না থাকলে দেশের শাসনব্যবস্থা অবনতির আর কত গভীরে যেতে পারত? প্রতিবিধায়ক ভারসাম্য ও ক্ষমতার পৃথকায়ন অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও সংসদ যদি বছরের পর বছর অকার্যকর থাকে, স্বাধীন সাংবিধানিক নির্বাচন কমিশন থাকা সত্ত্বেও যদি বিনা ভোটে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হতে পারে, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও যদি রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা যায়, জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীনরা কব্জা (ঈধঢ়ঃঁৎব) করে নিতে পারে এবং সংবিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সরকার যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংবিধানে প্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতাগুলো লঙ্ঘিত করতে পারে, তাহলে এগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকা বা না থাকার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এক কথায় বলা যায়, সাধারণ জনগণের জন্য কোনো পার্থক্য নেই। অতএব জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা এবং পরিবর্তিত বর্তমান বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সামর্থ্য গড়ে ওঠে, সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অতি সত্বর নতুন সংবিধান প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান সংবিধানের পরিবর্তন বা সংশোধনী করে যেমন মানুষের যুগোপযোগী আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটানো যাবে না, তেমনি অপ্রতিরোধ্য তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রাণপ্রযুক্তির অগ্রসরমান গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের যে রূপান্তরণ প্রয়োজন তাও করা যবে না। যেমনটি দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, 'সমাজকে পুনর্নির্মাণ করতে হলে পুরনো বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে তা করা সম্ভব নয়।' \হবাংলাদেশের বর্তমান ঘুণেধরা ও অস্থিতিশীল সমাজকে স্থিতিশীল করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন সংবিধান রচনার জন্য একটি ব্যাপক জনপ্রতিনিধিত্বভিত্তিক 'সংবিধান প্রণয়ন কমিশন' নিয়োগ করা অতীব জরুরি। পরবর্তীকালে কমিশন কর্তৃক প্রণীত সংবিধান দফাওয়ারি অনুমোদনের মাধ্যমে সম্মতির জন্য গণভোটে দেওয়া আবশ্যক। নতুন সংবিধান প্রণয়নে যেসব বিষয় বিশেষভাবে নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন সেগুলো হলো; সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব; আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং নীতিগুলোর সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বয়ান; নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা ও অধিকারগুলোর সম্প্রসারণ ও নিশ্চিতকরণ; নাগরিকদের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো নির্ধারণ; সংবিধানে একজন উপ-রাষ্ট্রপতির বিধান সন্নিবেশ; রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও তাদের কর্তব্যগুলোর স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন এবং নির্বাচকমন্ডলীর সম্প্রসারণ ও সুনির্দিষ্টকরণ; দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ : (ক) উচ্চকক্ষ ও (খ) সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে নিম্নকক্ষ প্রতিষ্ঠা; উচ্চকক্ষের নির্বাচকমন্ডলীর সংজ্ঞায়ন; উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ও কর্তব্যকর্মের সংজ্ঞায়ন; সংসদ, নির্বাহী শাখা, বিচার বিভাগ, সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলির পৃথকায়ন, ভারসাম্য ও প্রতিবিধায়ক ভারসাম্যের স্পষ্টতা ও স্থায়ীকরণ; পার্লামেন্টে গ্রম্নপ গঠন করার নীতি ও সংসদ সদস্যদের সার্বভৌমত্ব; নারীদের মতো অন্যান্য গোষ্ঠী, দেশে যে সব গোষ্ঠীর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত তাদের জন্য সংসদের আসন সংরক্ষিত রাখার কথা বিবেচনা করা; আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচন; সাংবিধানিক আদালত ও প্রশাসনিক আদালত গঠন; ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতাকে নিম্নাভিমুখীকরণ; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরও সুনির্দিষ্ট ভূমিকা, ক্ষমতা ও কার্যাবলি নির্ধারণ; নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা; সরকারের কার্যকালের মেয়াদ নির্ধারণ (বাংলাদেশের জনসমষ্ঠির মতো উদ্বায়ী (ঠড়ষধঃরষব), অতিমাত্রায় রাজনীতিপ্রিয়, প্রগতিশীল কিন্তু সহজে মেরুকরণে প্রভাবিত ও দ্রম্নত পরিবর্তশীল সমাজে পাঁচ বছরের মেয়াদ অতিমাত্রার বেশি বলে মনে হয়); রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার কার্যক্রম; গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দিষ্টকরণ; শাসনের গুণগত উন্নয়ন; সুশীল সমাজের জন্য অধিকতর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা নির্ধারণ; রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে অধিকতর জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা; সিদ্ধান্ত প্রণয়নকে আরও স্বচ্ছ করে তোলা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিরোধক ব্যবস্থা; জাতীয় পর্যায়ে সংঘাত হ্রাস; রাজস্বনীতিতে শৃঙ্খলা ও মুদ্রানীতির আইনি নিয়ন্ত্রণ; নিরবচ্ছিন্ন আর্থ-রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার পরিচালনা ও বাধ্যবাধকতা আরোপ; এবং মৌলিক ইসু্যগুলো ও সংবিধানের ভবিষ্যৎ সংশোধনের প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের শর্তারোপ। উপর্যুক্ত মৌলিক বিষয়গুলো ছাড়াও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্যান্য আরও প্রয়োজনীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন অতীব জরুরি। নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে পুরনো, ঘুণেধরা সনাতন আইনগুলো বাতিল করে দিতে হবে। পরে নতুন আইনের যথাযথ ও সমপ্রয়োগেই কেবল বাংলাদেশের বর্তমানে বিশৃঙ্খল, অস্থিতিশীল ও অচল সমাজকে স্থিতিশীল ও সচল করে মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করার রূপকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব। অন্যথায় দেশ ও সমাজ ক্রমবর্ধিত হারে শাসনের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। মাঝারি আয়ের দেশের তালিকায় নাম লেখানোর পরিবর্তে অনাহুত হলেও ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় স্থান করে নেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে